মুহররম ও আশুরা : কোরান-সুন্নাহের দিক নির্দেশনা

।। মওলানা মহবুবুর রহমান।।
বরাক তরঙ্গ, ১৭ জুলাই : ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ের সুবিন্যস্ত বিধিমালা দিয়েছে ইসলাম। মুসলিমদের কোরান সুন্নাহ সমর্থিত ও শরিয়ত সম্মত জীবনধারায় অভ্যস্ত হওয়াই কাম্য। আরবি বর্ষধারায় সর্বপ্রথম মাস মুহররম (মহরম) অত্যন্ত  ফজিলতপূর্ণ মাস। কোরানের ভাষায় এটি ‘আরবাআতুন হুরুম’-অর্থাৎ চার সম্মানিত মাসের অন্যতম।

এ মাসে রোজা রাখার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত এক হাদিসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘রমজানের পর আল্লাহর মাস মুহররমের রোজা হল সর্বশ্রেষ্ঠ।’
সহীহ মুসলিম ২/৩৬৮; জামে তিরমিজি ১/১৫৭ এর মধ্যে আশুরার রোজা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমজান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোজা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি।
সহীহ বুখারি ১/২১৮

হজরত আলি রাঃ কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমজানের পর আর কোন মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোজা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জনৈক সাহাবি করেছিলেন, তখন আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও, তবে মুহররম মাসে রাখো। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহতাআলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’ জামে তিরমিজি ১/১৫৭

হজরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে ৯ তারিখেও অবশ্যই রোযা রাখব।’ সহীহ মুসলিম ১/৩৫৯

মহররম ও আশুরাকেন্দ্রিক কুসংস্কারাদি :

এ মাসে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এদিনে আল্লাহতাআলা তাঁর কুদরত প্রকাশ করেছেন। বনি ইসরাইলের জন্য সমুদ্রে রাস্তা বের করে দিয়েছেন এবং তাঁদের নিরাপদে পার করে দিয়েছেন। আর একই রাস্তা দিয়ে ফেরাউন ও তার অনুসারীদের ডুবিয়ে মেরেছেন।সহিহ বুখারি ১/৪৮১

এ মাসের একটি ঘটনা শাহাদাতে হুসাইন রাঃ। বলাবাহুল্য যে, উম্মতের জন্য এই শোক সহজ নয়। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরই তো শিক্ষা-‘নিশ্চয়ই চোখ অশ্রুসজল হয়, হৃদয় ব্যথিত হয়, তবে আমরা মুখে এমন কিছু উচ্চারণ করি না যা আমাদের রবের কাছে অপছন্দনীয়।’

অন্য হাদিসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই যারা মুখ চাপরায়, কাপড় ছিড়ে এবং জাহেলি যুগের কথাবার্তা বলে।’

অতএব শাহাদাতে হুসাইন রাঃ কে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হওয়া এবং সব ধরনের জাহেলি রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য।
তবে ঐ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমূহ শোষন, দমন, নির্যাতন, অপশাসন, অনধিকার প্রবেশ, জুলুম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে প্রতিরোধমূলক চূড়ান্ত কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এবং সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় প্রাণপণ লড়াই করে প্রয়োজনে জীবন বিলিয়ে দেওয়ার জন্য প্রতীজ্ঞ হতে হবে।

এ মাসে যেসব অনৈসলামিক কাজকর্ম ঘটতে দেখা যায় তার মধ্যে তাজিয়া, শোকগাঁথা পাঠ, শোক পালন, মিছিল ও র‌্যালি বের করা, শোক প্রকাশার্থে শরীরকে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এসব রসম-রেওয়াজের কারণে এ মাসটিকেই অশুভ মাস মনে করার একটা প্রবণতা অনেক মুসলমানের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়।

এজন্য অনেকে এ মাসে বিয়ে-শাদি থেকেও বিরত থাকে। বলাবাহুল্য এগুলো সম্পূর্ণ অনৈসলামিক ধারণা ও কুসংস্কার।

মোটকথা, এ মাসের করণীয় বিষয়গুলো যখা, তওবা-ইস্তেগফার, নফল রোজা এবং অন্যান্য পূণ্য কর্ম। এসব বিষয়ে যত্নবান হওয়া এবং সব ধরনের কুসংস্কার ও গর্হিত রসম-রেওয়াজ থেকে বেঁচে কোরান ও সুন্নাহ মোতাবেক চলাই মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। মহান আল্লাহ স্বীয় অসীম কৃপা বশে আমাদেরকে শরিয়তসম্মত ভাবে মুহররম মাস সহ সমূহ মোক্ষম ক্ষণের যথার্থ মূল্যায়ন করার তাওফিক দান করুন। স্রষ্টা সমীপে এই মিনতি।

Author

Spread the News