বিশ্ব তামাকবিরোধী দিবসে সচেতনতার দীপ্ত শপথে কাঁপল শিলচর

বরাক তরঙ্গ, ৩১ মে : এক অভূতপূর্ব গণসচেতনতার ছবি দেখা গেল বিশ্ব তামাকবিরোধী দিবসে, যখন শিলচর ক্যান্সার সেন্টার, অসম ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশনের (ACCF) ব্যানারে ও জেলা এনসিডি সেলের সহযোগিতায় আয়োজিত কর্মসূচিতে জনতার ঢল নামে। সমবেত কণ্ঠে ‘তামাককে না বলুন’ বার্তাটি যেন প্রতিধ্বনিত হলো গোটা শহরে—প্রতিরোধ ও প্রত্যয়ে গাঁথা এই দিবসটি হয়ে উঠল শুধু এক দিনের কার্যক্রম নয়, বরং তামাকমুক্ত ভবিষ্যতের লক্ষ্যে এক দীপ্ত শপথ।

সকালের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় বর্ণাঢ্য সচেতনতামূলক র‍্যালি, শিলচর ক্যান্সার সেন্টারের প্রাঙ্গণ থেকে। মেডিক্যাল সুপারিনটেন্ডেন্ট ডাঃ বিশ্বজিৎ ঘোষ এবং সিনিয়র রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট ডাঃ ফুলকুমারী তালুকদারের সম্মিলিত উদ্বোধনে র‍্যালিটি শহরের মূল সড়ক অতিক্রম করে পৌঁছে জনসাধারণের হৃদয়ে। হাতে প্ল্যাকার্ড, মুখে শ্লোগান—হাসপাতালের কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী, অভিভাবক ও সাধারণ নাগরিক সকলেই শপথ নেন তামাকবিরোধী জীবনযাপনের। র‍্যালির উন্মাদনায় ফুটে ওঠে একটিই বার্তা—তামাক নয়, বাঁচার অধিকারকে বেছে নিন।

তামাক বিরোধিতার এক অনন্য চিত্র রচিত হয় যখন সেন্টার প্রাঙ্গণে জব্দকৃত তামাকজাত দ্রব্য একযোগে আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। এই প্রতীকী পদক্ষেপে যেন উঠে আসে সামাজিক প্রতিবাদের এক অনন্য ভাষা—তামাকের দাপটের বিরুদ্ধে এক নিঃশব্দ অথচ দৃপ্ত বিদ্রোহ।

বিশ্ব তামাকবিরোধী দিবসে সচেতনতার দীপ্ত শপথে কাঁপল শিলচর

পরে সেন্টারের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত হয় সচেতনতামূলক সভা, যেখানে বক্তৃতা দেন বিশিষ্ট চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যপ্রশাসনের কর্মকর্তারা।  বিশ্বজিৎ ঘোষ তামাক ব্যবহারের সঙ্গে ক্যান্সারের গভীর সম্পর্কের দিকটি তুলে ধরে বলেন, “প্রতিরোধই একমাত্র পথ, আর তার মূলে রয়েছে সচেতনতা ও প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্তকরণ।”  ফুলকুমারী তালুকদার তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন, “তামাকজনিত ক্যান্সারের হার শিলচর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান। আমাদের সচেতনতা এবং শিক্ষা কার্যক্রম আরও বিস্তৃত হওয়া জরুরি।” জেলা এনসিডি সেলের জেলা নোডাল অফিসার রত্না চক্রবর্তীর বক্তব্যে উঠে আসে গ্রামীণ স্তরে চলমান সচেতনতামূলক প্রচারের ইতিবাচক প্রভাব ও ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনা।

তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে এক অনন্য উদ্যোগ হিসেবে ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ’ বিষয়ে এক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল গোলদিঘি মলে, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা রঙ ও রেখার মাধ্যমে তাদের তামাকবিরোধী ভাবনা প্রকাশ করে। সেখানকার বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা হয় এসএম দেব সিভিল হাসপাতালের সম্মেলন কক্ষে, যা যেন এক শিশুকণ্ঠে উচ্চারিত সচেতনতার বার্তা হয়ে ধ্বনিত হলো।

বিশ্ব তামাকবিরোধী দিবসে সচেতনতার দীপ্ত শপথে কাঁপল শিলচর

দিবসটির সবচেয়ে প্রাণবন্ত পর্বগুলির একটি ছিল শহরের চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আয়োজিত পথনাটিকা। অভিনয় ও আবেগ মেশানো এই নাট্যরূপের মাধ্যমে দর্শকদের সামনে তুলে ধরা হয় তামাকের ভয়াল গ্রাস। সাধারণ মানুষের সরব উপস্থিতি এবং তাঁদের মধ্যে আলোড়নের সঞ্চার, দিনটির সফলতার এক স্পষ্ট দিকচিহ্ন।

বিশ্ব তামাকবিরোধী দিবসে সচেতনতার দীপ্ত শপথে কাঁপল শিলচর

শুধু শহরেই নয়, সচেতনতার এই ঢেউ পৌঁছে যায় শিক্ষাঙ্গনেও। বাজারবাজার এলাকার এমএ লস্কর সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলে অনুষ্ঠিত হয় এক বিকল্প সচেতনতা সভা, যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সকলেই অংশগ্রহণ করে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব ও করণীয় বিষয়ে মুক্ত আলোচনা করে। এই সংলাপ যুবসমাজের মধ্যে একটি দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলে—কারণ তাঁরাই ভবিষ্যৎ, যাঁদের উপর নির্ভর করছে একটি তামাকমুক্ত সমাজ।

বিশ্ব তামাকবিরোধী দিবসের শেষে শিলচর যেন আরও কিছুটা জেগে উঠল, আরও কিছুটা দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে চলল সেই লক্ষ্যের দিকে—যেখানে ধোঁয়ার চাদরে নয়, আলোর পথেই হাঁটে নতুন প্রজন্ম। এই কর্মসূচি এক দিনের নিছক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এক সামাজিক আন্দোলনের সূচনা, যার প্রতিটি ধ্বনি বিশ্বমঞ্চের সেই বার্তাকেই অনুরণন করল—“তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করো, তামাক কোম্পানির প্রতারণা থেকে; গড়ে তুলো তামাকমুক্ত আগামী।”

Author

Spread the News