গণসমাবেশকে সফল করতে পথসভা ব্রডগেজ রূপায়ণ সংগ্রাম কমিটির
বরাক তরঙ্গ, ১০ ফেব্রুয়ারি : বরাক উপত্যকা সহ ত্রিপুরা, মণিপুর এবং মিজোরামের গণ-আন্দোলনের ফল স্বরূপ প্রায় ১৮ বছর পর গত ২০১৫ সালে ব্রডগেজ রেল পরিষেবার মাধ্যমে দেশের অবশিষ্ট অংশের সাথে এই অঞ্চলের রেলপথে সংযোগ ঘটে। ডিমা হাসাও পাহাড়ের মধ্য দিয়ে যাওয়া বর্তমান ব্রডগেজ রেল রুট নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়েই শুরু হয়। নিম্নমানের কাজ, মাটির গঠন সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করতে না পারা এবং পাহাড়ি জলের গতির নিয়ন্ত্রণে নির্ভুল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি গ্রহণ করতে না পারায় প্রায়ই রেল চলাচল বিঘ্নিত হয়ে থাকে। চূড়ান্ত বিভাগীয় গাফিলতি এবং অপরিপক্কতার ফলে এই বৃহৎ অঞ্চলের জনগণকে ভুগতে হচ্ছে।
‘শিলচর-লামডিং ব্রডগেজ রূপায়ণ সংগ্রাম কমিটি’ ২০০৯ সাল থেকেই ব্রডগেজ রূপায়ণের গণসংগ্রামে নিয়োজিত। ২০১৫ সালে ব্রডগেজ রেল পরিষেবা চালু হওয়ার পরপরই ২০১৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি হাইলাকান্দি জেলাতে অনুষ্ঠিত গণ-সমাবেশে ‘চন্দ্রনাথপুর-লংকা’ দ্বিতীয় রেলপথের দাবি উত্থাপন করে তৎকালীন রেল প্রতিমন্ত্রী মনোজ সিনহার হাতে স্মারকপত্র প্রদান করা হয়। ব্রডগেজ রূপায়ণ সংগ্রাম কমিটি নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে যে, রেল পরিষেবার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি পণ্য পরিবাহী গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি বর্তমান পাহাড় লাইনের উপর চাপ সৃষ্টি করবে এবং গঠন দুর্বলতা যে কোনও সময়েই বিপর্যয় ডেকে আনবে। সংগ্রাম কমিটির সেই আশংকা সত্য বলে প্রমাণিত হয়। প্রথম রেল চলাচলের এক বছরের মাথায় প্রথম বর্ষাতে ফাইডিং অঞ্চলে ব্যাপক ধস নেমে প্রায় মাসাধিক কাল রেল চলাচল বন্ধ থাকে। বারংবার এরকম ঘটনার পর ২০২২ সালে বিধ্বংসী ভূমিধস এবং পাহাড়ি জলপ্রবাহে সমগ্র হাফলং স্টেশন সহ আরও বিস্তৃত অঞ্চল একরকম নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ে।

প্রায় দীর্ঘ কয়েক মাস পরিষেবা বন্ধ থাকার পর রেল বিভাগের তৎপরতায় আবার পথটি চালু হয়। ২০২৪-এ ডিমা হাসাও পাহাড়ের মুপা অঞ্চলে মালগাড়ি লাইনচ্যুত হলে রেল পরিষেবায় বিপত্তি ঘটে, প্রায় দুই মাস লাইন মেরামতির কাজে রেল পরিষেবা অনিয়মিত হয়ে পড়ে। এটা এই পথে কোনও নতুন ঘটনা নয়, বর্ষা সহ অন্য সময়েও এই পাহাড়ি লাইনে প্রায়শই নানা প্রতিকূলতায় রেল পরিষেবা বন্ধ থাকে। বর্তমান পাহাড় লাইনের উপর প্রতিনিয়ত চাপ বাড়ছে, আরও বাড়বে, ভবিষ্যতে ত্রিপুরা, মণিপুর, মিজোরাম সহ বরাক উপত্যকার যাত্রীদের দাবি অনুযায়ী রেল সংখ্যা অবশ্যই বাড়বে। এতে ট্রেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং নানা বিপর্যয় ঘটছে।

সূত্র মতে, ১৯৮৪ সালে চন্দ্রনাথপুর-লংকা পথের একটি সমীক্ষা হয় এবং এতে প্রায় ৩৪ কিঃ মিঃ রাস্তা কম এবং ভূমিধসপ্রবণ পাহাড় অনেকটাই এড়ানো সম্ভব বলে তারা উল্লেখ করেন। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সেই সার্ভে (সমীক্ষা) রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। পরিস্থিতি বিবেচনায় আবারও গত ০১-০৬-২০২২ এ রেল মন্ত্রক থেকে ‘শিলচর-চন্দ্রনাথপুর-লঙ্কা দ্বিতীয় রেলপথ হিসাবে মান্যতা দিয়ে সার্ভে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই দ্বিতীয় রেলপথ সার্ভের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট জনসমক্ষে আজঅবধি প্রকাশ করতে পারল না রেল বিভাগ। কাজ শুরু করারও কোনও সংবাদ জনগন পাচ্ছে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে আগামী বর্ষা মরশুম শুরুর পূর্বে উন্নত বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বর্তমান পাহাড় লাইনের পূর্ণ সংস্কার করে এই লাইনের উপর দিয়ে চলাচল করা ট্রেনগুলো যাতে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে তার ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি এই উপত্যকার জনসাধারণের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার স্বার্থে শিলচর-বদরপুর, চন্দ্রনাথপুর-লঙ্কা হয়ে গৌহাটি পৌঁছানোর দ্বিতীয় রেলপথ প্রকল্পটি যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বাস্তবায়ন করার জন্য সংগ্রাম কমিটি দৃঢ়ভাবে দাবি জানাচ্ছে।

উল্লেখ্য, এই নতুন রেলপথ বাস্তবায়িত হলে বর্তমান একমাত্র ট্রেকের উপর চাপ কমবে। ফলে বিপর্যয়ের সম্ভাবনা কমবে, যানজটের সমস্যাও কিছুটা লাঘব হবে। ন্যূনতম ৩০-৩৫ কিঃ মিঃ দূরত্ব কম হবে ফলে যাত্রার সময় কম লাগবে। সুড়ঙ্গের সংখ্যা কম হবে। সমতল মাটির উপর দিয়ে বেশি রাস্তা থাকার ফলে ভূমিধসপ্রবণ অঞ্চল অনেকটাই এড়ানো যাবে। ফলে এই নতুন রেলপথ নির্মাণের দাবি আদায় করতে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু আন্দোলন ব্যতীত দাবি আদায় হয় না, এই অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্র উপত্যকার জনগণকে আবারও রাস্তায় নেমে দাবি আদায়ের সংগ্রামকে শক্তিশালী করতে হবে। এই লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই শিলচর শহর এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মাইক যোগে প্রচার এবং পথসভা শুরু হয়েছে। আজ শিলচর শহরের লিঙ্ক রোড থেকে শুরু করে সোনাই রোড, রাঙ্গীরখাড়ী সহ বিভিন্ন স্থানে পথসভা অনুষ্ঠিত হয়।

পথসভায় বক্তব্য রাখেন নাগরিক অধিকার রক্ষা সমন্বয় কমিটির সম্পাদক হরিদাস দত্ত, প্রবীর রায় চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মলয় ভট্টাচার্য, সংগ্রাম কমিটির অন্যতম আহ্বায়ক অজয় রায়, মধুসূদন কর প্রমুখ। বক্তারা চন্দ্রনাথপুর -লংকা রেলপথ নির্মাণের দাবিতে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলতে সর্বস্তরের জনসাধারণের অংশগ্রহণ কামনা করেন। এই দাবিকে গণদাবি হিসাবে বিবেচনা করে যোগাযোগ ব্যবস্থার এই দ্বিতীয় রেলপথকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে সংগ্রাম কমিটি। রেল বিভাগের উপর চাপ সৃষ্টি করে দাবি আদায় করার লক্ষ্যে আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় গান্ধীভবন শিলচরে এক গণ-সমাবেশের আহ্বান করা হয়েছে। উক্ত গণসমাবেশে উপস্থিত থেকে আগামী দিনের আন্দোলনের রূপরেখা প্রস্তুত করতে উদ্যোগী হতে আহ্বান জানানো হচ্ছে।