এক অনন্য সাধারণ উৎসব ঈদ-উল আজহা

এক অনন্য সাধারণ উৎসব ঈদ-উল আজহা

।। মাওলানা মহবুবুর রহমান ।।
ইনচার্জ, আইএইচআরএসিএস, ইন্ডিয়া।
বরাক তরঙ্গ, ১৭ জুন : আরবি বর্ষ ধারায় আবারও আমাদের মাঝে এসে হাজির বিশ্বজনীন ত্যাগের উৎসব ঈদ-উল আজহা। মহান শ্রষ্ঠার প্রতি সঠিক আনুগত্য, তার সন্তুষ্টি ও মানব কল্যাণে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করাই মূলত: ঈদ-উল আজহা বা কোরবানি ঈদ। এ ঈদের আনন্দ হল ত্যাগের আনন্দ ও উৎসর্গের আনন্দ। শুধু ভোগে নয়, ত্যাগের মধ্যেও আনন্দ ও সুখ আছে। দিনটি এই শিক্ষা দেয় যে, প্রকৃত সুখ আর আনন্দের ঠিকানা সম্পদে নয়, ভোগে নয় বরং ত্যাগে। মানুষের যা কিছু আছে তা অন্যের জন্য, ত্যাগের মাধ্যমেই প্রকৃত সুখ।

মুসলমানদের জন্য অফুরন্ত খুশির বার্তা নিয়ে হাজির হয় দু’টি দিন- ঈদ-উল ফিতর ও ঈদ-উল আযহা। ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব বয়সী মুসলমানদের জীবনে ঈদ হাজির করে আনন্দের বন্যা। এমনকি  অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরকেও ঈদের আনন্দ স্পর্শ করে। মানবতা, সাম্য, ত্যাগ ও সহমর্মিতার বিষ্ময়কর ও অপরূপ আলোকপ্রভা এই ঈদের উৎসবে প্রকাশিত হয়, যা ইসলামের মাহত্ম্য ও সর্বজনীনতার প্রতীক।

পশু জবেহ করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রচেষ্টা মানব ইতিহাসের জন্মলগ্ন থেকেই চলে আসছে। মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর আদেশ পালনার্থে নিজ পুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.)কে কোরবানি করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। এ ঘটনায় কোরবানির গুরুত্ব ও তাৎপর্য আরো বেড়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রভুপ্রেমে প্রাণ উৎসর্গ করা একটা পূণ্যময় ইবাদত বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। কোরবানী এমন একটা মর্যাদাকর বিষয় যাতে রয়েছে একাধারে আত্মগঠন ও সুস্থ সমাজ গঠনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপাদানাবলী। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের মধ্যে কোনো ধরণের পার্থক্য নেই। পার্থক্য রয়েছে শুধু আল্লাহভীতির ক্ষেত্রে, সত্য ও অসত্যের মধ্যে, ঈমানদার ও বেঈমানের মধ্যে। এই দৃষ্টিকোন থেকেই তাৎপর্য অনুমেয়।

আল্লাহর সস্তুষ্টি অর্জনের বড় মাধ্যম হিসেবে ত্যাগ স্বীকার করাই হলো কোরবানি। প্রকৃত অর্থে নিজেকে আমৃত্যু আল্লাহর রাস্তায় সমর্পন করা। ইসলামি শরিয়তে মুসলিম জাতির জীবনটাই একটি কোরবানিতুল্য। এ কোরবানি হতে পারে জান, মাল, সম্পদ, সময়, স্বার্থ, ইচ্ছা ও পশুর কোরবানি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্বার্থত্যাগ, আত্মত্যাগ ও সম্পদত্যাগ -এটাই হলো কোরবানি। ঈদ-উল আযহার অর্থ নিছক পশু কোরবানি নয় বরং ত্যাগ ও উৎসর্গের অঙ্গীকার।

প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তার পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) কোরবানির নিমিত্তে অনন্য ত্যাগের আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। দিনটি হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর ঐতিহাসিক ত্যাগের মহান স্মরণিকা। কোরবানির পশু জবাই আসলে প্রতীকী ব্যাপার। আল্লাহপাক নিজেই বলেছেন- পশুর গোশত, চামড়া, রক্ত কিছুই তার নিকট পৌঁছে না, পৌঁছে শুধু তাকওয়া ও পরহেজগারী।

হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর অনন্য ত্যাগের আদর্শ স্থাপনের ফসলই হল কোরবানি। কোরবানি শুধুমাত্র একটি আনন্দ সর্বস্ব উৎসব নয়। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা ও দর্শন। ঈদ-উল আজহা আত্মোৎসর্গের প্রেরণায় উজ্জীবিত এক অনন্য সাধারণ আনন্দ উৎসব।

মানুষের অন্তরাত্মা পাপে ও গোনাহে ভরা, যেটার সম্মিলিত নাম পশুত্ব। সর্বপ্রথম এই পাপিষ্ট আত্মা অর্থ্যাৎ পশুত্বকেই কোরবানি করার পর পশু কোরবানি করা উচিত। হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর পরিবার সারা মুসলিম উম্মাহর জন্য আদর্শ পরিবার। মুসলিম পরিবারের মধ্যে ধর্মীয়, নৈতিক মূল্যবোধ ও আদর্শবোধ স্মরণ করিয়ে দেয়। মুসলিম পরিবারের মূল্যবোধের ভিত্তি হলো আল কোরআন ও সুন্নাহ। এতে প্রতিফলিত হয়েছে হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর আদর্শের তাত্বিক ও বাস্তবরূপ। প্রত্যেক মুসলিম পরিবারের সদস্যদের মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্যই হজ ও কোরবানি।

কিন্তু দু:খের বিষয় বর্তমান বিজাতীয় অপসংস্কৃতি এবং চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ আমাদের নৈতিক, আদর্শিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর চরম আঘাত হেনেছে। যার ফলে মুসলিম পরিবারের সদস্যরা আজ ভিন্ন ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করায় তাদের নৈতিক আদর্শ ও মূল্যবোধ সর্বক্ষেত্রে পদদলিত। তাই হযরত ইব্রাহিম (আ.), বিবি হাজেরা এবং হজরত ইসমাইল (আ.) এর আদর্শ ও মূল্যবোধ আমাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা উচিত।

পরিশেষে প্রত্যাশা,ঈদ হয়ে উঠুক বিশ্বজনীন সম্প্রীতি ঐক্য,সহানুভূতির এক অনুসঙ্গ। ঈদ বয়ে আনুক মহানুভবতা ও মানবতার  উচ্ছাসিত তরঙ্গ। ঈদ হোক বিশ্বমানবের মুক্তির আঁধার।ঈদে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ুক শান্তির জোয়ার। ইতি হোক ফিলিস্তিনি শিশুদের আর্তচিৎকার। বিশ্ব বিবেক জেগে ছুঁড়ুক প্রত্যয়ী প্রতিবাদী হুঙ্কার। ঈদ হোক সর্বজনীন। “তাক্বাব্বালাল্লাহু মিন্না ও মিনকু। ঈদুকুম সায়ীদ।”

Author

Spread the News