মোহাম্মদ জনি, পাথারকান্দি।
বরাক তরঙ্গ, ১৪ নভেম্বর : অসমের বরাক উপত্যকার গ্রামীণ নারী ও যুবসমাজের টেকসই দক্ষতা বিকাশ—এই গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী বিষয়ে কেন্দ্র করে পাথারকান্দি কলেজে অনুষ্ঠিত হলো দুই দিবসীয় জাতীয় সেমিনার। আইসিএসএসআর–স্পনসর্ড এই বহুল প্রতীক্ষিত সেমিনারটি আয়োজন করে কলেজের মহিলা সেল এবং আইকিউএসি। ১২ ও ১৩ নভেম্বর অ্যাকাডেমিক, গবেষণা, উদ্যোক্তা ও সামাজিক উন্নয়ন—এই চারটি ক্ষেত্রের প্রায় সব বিশিষ্ট জনের উপস্থিতি সেমিনারটিকে পরিণত করে এক সমৃদ্ধ জ্ঞানসমাবেশে। সেমিনারের সভাপতিত্ব করেন পাথারকান্দি কলেজের অধ্যক্ষ ড. মঞ্জুরুল হক। দুই দিনের এই অনুষ্ঠানে বরাক উপত্যকা ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত শিক্ষা–গবেষণা–উদ্যোক্তা জগতের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তাঁদের মতে, গ্রামীণ নারীর দক্ষতা উন্নয়ন শুধু ব্যক্তিগত নয় পরিবার, সমাজ ও আঞ্চলিক অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়নের ভিত্তি। ১২ নভেম্বর সকাল ১০-৩০ মিনিটে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে উদ্বোধনী অধিবেশন শুরু হয়। এরপর অতিথিদের আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা ও সম্মাননা প্রদানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সেমিনারের মূল আলোচনা। পাথারকান্দি কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. সালিকুজ্জামান স্বাগত ভাষণে বলেন গ্রামীণ নারী ও যুবসমাজকে দক্ষতা উন্নয়নের মূল স্রোতে যুক্ত করলেই বরাক উপত্যকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।সেমিনারের আহ্বায়ক ড. কে. তামনা সিংহ তাঁর বক্তৃতায় গ্রামীণ এলাকার সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য দক্ষতা বিকাশকে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার বলে উল্লেখ করেন।মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ বিভাগের অধ্যাপক অরূপ বর্মন। তিনি বলেন, উদ্ভাবনী জীবিকানির্ভর কৌশল, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং স্থানীয় সম্পদকে ঘিরে উদ্যোক্তা সৃষ্টিই ভবিষ্যতের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নির্ধারণ করবে। তিনি গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের জন্য প্রয়োজনীয় নীতি–সহায়তা, প্রশিক্ষণ–পরিকাঠামো এবং প্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সেমিনারের অন্যতম আকর্ষণ ছিল ‘উদ্যোক্তা অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি’ পর্ব। বিভিন্ন অঞ্চলের চারজন সফল উদ্যোক্তা অংশগ্রহণ করেন বাপন দাস, প্রতিষ্ঠাতা, The Graduate ফারমের মিসেস সানালেম্বি দেবী, সিইও, বিকাসি অ্যাগ্রো প্রোডিউসার কোম্পানি লিমিটেড, কাছাড় স্বপন কুমার সিংহ, পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, বরাক ডেইরি প্রোডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড মিস শেখ মোইদুন নিলুফার, হ্যান্ডলুম ডিজাইনার, ডিজাইনারস কাউন্সিল, হস্তশিল্প মন্ত্রণালয়, ভারত সরকারএঁরা তাঁদের শিল্প–জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা, সংগ্রাম, উদ্ভাবনী প্রয়াস এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার পথ নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা করেন।
কৃষি–উদ্যোগ, নারী-নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠান এবং টেকসই জীবিকা নিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা উপস্থিত শ্রোতাদের অনুপ্রাণিত করে। দুপুরের সেশনে দুটি উচ্চমানের আমন্ত্রিত বক্তৃতা উপস্থাপিত হয় ড. সুচিত্রা দাস, সহকারী অধ্যাপক, করিমগঞ্জ কলেজ গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিকূলতা তিনি নারী উদ্যোক্তাদের সামনে থাকা বাধাগুলি—সংগঠনজনিত সমস্যা, অর্থসংস্থান, বাজারসুলভ সুযোগ, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন।ড. সঞ্জয় সিনহা, সহকারী অধ্যাপক, অসম বিশ্ববিদ্যালয় অসমে নারী-স্বত্বাধীন উদ্যোগের প্রকৃতি, গঠন ও পরিসর: বরাক উপত্যকার প্রেক্ষাপট তাঁর বক্তব্য নারী উদ্যোক্তা বৃদ্ধির গতিধারা, নীতিনির্ভর সুযোগ, বাজার বাস্তবতা এবং আগামী দিনের পরিকল্পনার সামগ্রিক বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ।এই সেশনে ড. সুচিত্রা দাসের সভাপতিত্বে ১০টি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়।সেমিনারের দ্বিতীয় দিনের আলোচনার শুরু হয় তিনটি শক্তিশালী আমন্ত্রিত বক্তৃতা দিয়ে ড. যোগীশারাধ্যা আর, সিনিয়র সায়েন্টিস্ট, আইসিএআর-কেভিকে, হাইলাকান্দি কৃষিতে টেকসই গ্রামীণ উদ্যোক্তা সৃষ্টি: উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের অনুঘটক ড. বিবাস রাজকুমার, সহকারী অধ্যাপক, পিডিইউএএম, এরালিগুল “উদ্ভিদ বৃদ্ধিপ্রবণ রাইজোব্যাকটেরিয়া: টেকসই কৃষির নয়া দিগন্ত ড. কে. তামনা সিংহা, সহকারী অধ্যাপক, উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ, পাথারকান্দি কলেজ গ্রিন টেকনোলজি এডুকেশন: টেকসই পাঠ্যক্রম নির্মাণের সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ যুবসমাজের দক্ষতা উন্নয়ন, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, টেকসই কৃষিচর্চা—এই তিনটি বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য সেমিনারকে নতুন ভাবনার দিগন্তে পৌঁছে দেয়।এরপর শুরু হয় গবেষণা পত্র উপস্থাপনের সেশন–২ ও সেশন সভাপতিত্ব করেন ড. সঞ্জয় সিনহা, সহযোগিতায় ছিলেন ড. সুইটি নাথ বড়ভূইয়া ও ড. শতরূপা দেব।পরের সেশনে সভাপতিত্ব করেন ড. বিবাস রাজকুমার, কো–চেয়ার হিসেবে ছিলেন ড. জয়নুল হক ও ইসতিয়াক হুসেন মজুমদার। এই সেশনে উল্লেখযোগ্য বক্তৃতা ড. এম নীঙাম্বা সিংহ, অয়েস্টার মাশরুমের জৈবচাষ ও জিরো-ওয়েস্ট সার্কুলার ফার্মিং মডেল ড. অমরেন্দ্রনাথ চৌধুরী: ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটস (আইপিআর): উদ্ভাবন থেকে বাজারের পথে এই আলোচনাগুলি নতুন গবেষণা, প্রযুক্তি এবং গ্রামীণ উন্নয়নের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে উপস্থিতদের চিন্তাকে আরও গভীর করে।দুই দিনের আলোচনা শেষে সমাপনী অধিবেশনে অংশগ্রহণকারীরা তাঁদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। নতুন ভাবনা, গবেষণার নতুন দিক, গ্রামীণ নারী ও যুবশক্তির ভবিষ্যৎ পথরেখা—সবকিছু মিলিয়ে সেমিনারটি হয়ে ওঠে অত্যন্ত ফলপ্রসূ।গবেষকদের মধ্যে সনদপত্র বিতরণ করা হয়।

আয়োজক কমিটি আইসিএসএসআর, নয়াদিল্লিকে আর্থিক সহযোগিতার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানায় এবং সব শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অতিথিদের সফল সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে।দুই দিনের এই জাতীয় সেমিনারটি প্রমাণ করলো—বরাক উপত্যকার গ্রামীণ নারীরা শুধু সক্ষমই নয়, সঠিক সহায়তা ও দক্ষতা প্রশিক্ষণ পেলে তাঁরা সমাজ ও অর্থনীতির পরিকাঠামোকে বদলে দেওয়ার শক্তি রাখেন।টেকসই উন্নয়ন, উদ্যোক্তা সৃজন, গ্রিন টেকনোলজি, কৃষি উদ্ভাবন সব মিলিয়ে সেমিনারটি বরাক উপত্যকায় এক নতুন পরিবর্তনের ইঙ্গিত রেখে গেল।


