প্রান্তিক ভাষাগুলির সমৃদ্ধির লক্ষ্যে আরও কাজ করা উচিত : উপাচার্য পন্থ
জগন-যিশু স্মরণ আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে____
বরাক তরঙ্গ, ২২ জুলাই : ২১ জুলাইর ভাষা শহিদদের স্মরণ করল আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ও। এদিন সকালে ভাষা শহিদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদনের মাধ্যমে শুরু হয় শহিদ তর্পণ অনুষ্ঠান। পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করেন নিবন্ধক ড. প্রদোষ কিরণ নাথ, ভারতীয় ভাষা অনুষদের অধ্যক্ষ অজিত কুমার বৈশ্য, অর্থনীতি ও বাণিজ্য অনুষদের অধ্যক্ষ মেহমুদ আলম আনসারি, গণজ্ঞাপন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক চার্বাক, সংস্কৃত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শান্তি পোখরেল, বাংলা বিভাগের বরিষ্ট অধ্যাপক বেলা দাস, কবি চন্দ্রিমা দত্ত সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, গবেষক, শিক্ষাকর্মী ও ছাত্রছাত্রীরা।

এদিন শহিদ দিবসের মূল অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্বপ্না দেবী স্মৃতি সদনে’। অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে আয়োজিত হয় আলোচনাসভা। এতে পৌরোহিত্য করেন বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক অজিত কুমার বৈশ্য। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক দেবাশিস ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, বরাক উপত্যকার বিভিন্ন পর্যায়ে সংগঠিত ভাষা আন্দোলন ছিল ভারতবর্ষের বহুভাষিক ও বহুসাংস্কৃতিক চরিত্রের ওপর আঘাত প্রতিরোধের সংগ্রাম। আজ বিশ্বায়নের যুগে মানুষের চাহিদার বদলের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত মাতৃভাষাই কম বেশি আক্রান্ত। আর এরই সূত্রে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে ভাষা সংস্কৃতির উপর আক্রমণ প্রতিরোধের চেতনাও। এই পটভূমিতে তাই ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস ও উত্তরাধিকারের প্রশ্নকে আজকের বাস্তবে দাঁড়িয়ে পুনঃপাঠের প্রয়োজন রয়েছে।

উপাচার্য অধ্যাপক রাজীব মোহন পন্থ ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বলেন, উত্তর-পূর্ব ভারত বহু সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির যথার্থ দৃষ্টান্ত। এই বৈচিত্র্যই আমাদের দেশের শক্তি আর সৌন্দর্য। প্রতিটি ভাষা বিকাশের সমান স্তরে অধিষ্ঠিত নয়, এটা মাথায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিদ্যায়তনিক পরিসরে বিশেষত ভাষা বিভাগগুলিতে যারা কাজ করেন, তাদের প্রান্তিক ভাষাগুলির সমৃদ্ধির লক্ষ্যে আরও কাজ করা উচিত বলে মনে করেন উপাচার্য।

আলোচনাসভার মূল বক্তা প্রাবন্ধিক ও কথাশিল্পী, বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের কাছাড় জেলা কমিটির সভাপতি সঞ্জীব দেব লস্কর সংক্ষিপ্ত পরিসরে ১৯৮৬র ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ছিয়াশির আন্দোলন দীর্ঘ ভাষা আন্দোলনের এমন এক পর্যায়, যা বহুভাষিক এই রাজ্যে ভাষা মাধ্যমের বিতর্ক ও ভাষা বিরোধের মীমাংসায় আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকে ত্বরান্বিত করেছে। জগন-যিশুর আত্মাহূতির তিন বছরের মাথায় আসাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংসদে পাশ হয়। বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে দক্ষিণ আসামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপিত হয়েছিল; ৮৬র পর এটা তীব্র আকার ধারণ করে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন স্কুল কলেজ মাদ্রাসার শিক্ষক আর বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন।
দক্ষিণ আসামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি ও বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের আন্তঃসম্পর্কের ব্যাখ্যা করে সঞ্জীববাবু সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় থেকে সুজিৎ চৌধুরী পর্যন্ত শিক্ষাবিদদের নানান মন্তব্য, শিক্ষা সংরক্ষণ সমিতির ভূমিকা, রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্ম শুরুর মাঝখানের ব্যবধান ইত্যাদির সতথ্য আলোচনা করেন। পনেরোজন শহিদ সহ বহু মানুষের আত্মত্যাগে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ইতিহাসকে কোনও কোনও মহল থেকে বিকৃত করার চেষ্টা হচ্ছে দেখে খেদ ব্যক্ত করেন সঞ্জীব দেব লস্কর।
সভাপতির বক্তব্যে ভাষাবিজ্ঞানী অজিতকুমার বৈশ্য বলেন, ভাষা হচ্ছে যোগাযোগের মাধ্যম, মানুষে মানুষে সম্পর্কের সেতু। আবার ভাষার সংসারে মাৎস্যন্যায়ও আরেক বাস্তব। এই বাস্তবতাকে জটিল করে তুলে রাজনীতি। এ প্রসঙ্গে মহারাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ভাষাবিতর্কের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন তিনি। মননঋদ্ধ এই আলোচনাসভায় প্রাসঙ্গিক বক্তব্য রাখেন সংস্কৃত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শান্তি পোখরেলও।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে ছিল কবিতা পাঠের আসর। কবি অধ্যাপক সুমন গুণের সঞ্চালনায় স্বরচিত কবিতা পড়ে শোনান বর্ষীয়ান কবি ও ভাষা সংগ্রামের গবেষক দিলীপ কান্তি লস্কর, কবি চন্দ্রিমা দত্ত, ড. মুজিব স্বদেশি, অধ্যাপক মহুয়া সেনগুপ্ত, বাংলা বিভাগের গবেষক সুরজিৎ প্রামাণিক, ঈপ্সিতা দেব ও শঙ্কুভূষণ লস্কর। শুরুতে সমবেত সঙ্গীত পরিবেশন করেন বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা। অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয় বিভাগের ছাত্রী তনুশ্রী চক্রবর্তীর নৃত্যের মাধ্যমে। গোটা অনুষ্ঠানের গ্রন্থনায় ছিলেন ড. রাহুল দাস ও অধ্যাপক রিন্টু দাস।