।। মিতা দাসপুরকায়স্থ।।
(প্রাবন্ধিক, শিলচর)
২৫ ডিসেম্বর : একটি মানুষের নির্মম হত্যা কখনওই শুধু একটি সংবাদ নয়, তা সময়ের নৈতিক মানচিত্রে গভীর দাগ কেটে যায়। দীপুচন্দ্র দাসের অমানবিক, বর্বরোচিত পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা তেমনি এক দগদগে ক্ষত। এই হত্যাকাণ্ড শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির প্রাণহানি নয়, এটি মানবাধিকারের উপর আঘাত, রাষ্ট্রের দায়িত্ববোধের উপর প্রশ্নচিহ্ন এবং উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানের উপর এক ভয়ংকর সতর্কবার্তা।
এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর দীর্ঘদিন ধরে চলা নির্যাতনের অভিযোগ আবারও আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে। হিন্দুদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর, মন্দিরে হামলা, ধর্ষণ, ধর্মান্তরকরণ,জোরপূর্বক উচ্ছেদ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার খবর নতুন নয়—কিন্তু একের পর এক নৃশংস ঘটনার পুনরাবৃত্তি এই অভিযোগের তীব্রতাকে আরও জোরালো অথচ অসহায় করে তুলে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সুরক্ষা কি কেবল সংবিধানের পাতায় সীমাবদ্ধ, নাকি বাস্তব জীবনে তার কোনো কার্যকর রূপ রয়েছে ?
এই পরিস্থিতির স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া পড়েছে সীমান্তের এপারে, ভারতবর্ষে। ভারতীয় সমাজে ক্ষোভ, উদ্বেগ ও অসন্তোষ বেড়েছে। কিন্তু এই প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে ‘সেভেন সিস্টার্স দখল’–জাতীয় উন্মাদনাপূর্বক উসকানিমূলক বক্তব্য, ভারতবিরোধী আজেবাজে মন্তব্য এবং সামাজিক মাধ্যমে বিদ্বেষমূলক প্রচার পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এসব বক্তব্য কেবল কূটনৈতিক শিষ্টাচারের পরিপন্থী নয়, এগুলি সীমান্তের দুই পারে বসবাসকারী সাধারণ মানুষের মনোবল ও নিরাপত্তাবোধকে ভেঙে দেয়।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব এখানে অত্যন্ত স্পষ্ট। ধর্ম, ভাষা বা জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে কোনো নাগরিক আক্রান্ত হলে তা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা কোনো ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই—এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের প্রশ্ন। অপরাধীর পরিচয় যাই হোক, তার বিরুদ্ধে দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্ত, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ—এই তিনটিই রাষ্ট্রের ন্যূনতম দায়িত্ব।
একই সঙ্গে এটাও সত্য যে, প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া যদি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে পরিণত হয়, তবে তার ফল ভয়াবহ। ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে—উত্তেজক ভাষা, আবেগতাড়িত প্রতিশোধস্পৃহা এবং রাজনৈতিক সুবিধাবাদ শেষ পর্যন্ত ক্ষতি করে সাধারণ মানুষেরই। সীমান্ত অঞ্চলের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দিনমজুর, ছাত্র, রোগী—সবাই প্রথমে আঘাত পান। বাণিজ্য ব্যাহত হয়, যাতায়াত সংকুচিত হয়, সাংস্কৃতিক ও মানবিক যোগাযোগে সন্দেহের দেয়াল ওঠে।

ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্ক কেবল দুই সরকারের সম্পর্ক নয়—ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির এক জটিল জালের নাম। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি থেকে শুরু করে নদী, বাণিজ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসা—সব ক্ষেত্রেই পারস্পরিক নির্ভরতা গভীর। এই সম্পর্কের অবনতি মানে কূটনৈতিক অস্বস্তির পাশাপাশি লক্ষ কোটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অস্থিরতা।
তাই প্রশ্ন উঠছে—এই জল কতদূর গড়াবে ? উত্তর নির্ভর করছে রাষ্ট্রের প্রজ্ঞা ও নাগরিক সমাজের দায়িত্বশীলতার উপর। এক পথ —যেখানে মানবাধিকারকে কেন্দ্রে রেখে স্বচ্ছ তদন্ত, সংখ্যালঘু সুরক্ষায় দৃশ্যমান পদক্ষেপ এবং অফলাইন ও অনলাইন উসকানিমূলক বক্তব্যের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া হবে। অন্য পথ সংঘাতের—যেখানে বক্তব্যের আগুনে রাজনীতি সেঁকে নেওয়া হবে, আর তার ছাই কুড়োবে সাধারণ মানুষ। এই সংকটকালে গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী সমাজ ও নাগরিকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যাচাইহীন তথ্য, অতিরঞ্জিত শিরোনাম কিংবা সামষ্টিক দোষারোপ পরিস্থিতিকে আরও বিষাক্ত করে। প্রতিবাদ হোক ন্যায়ের পক্ষে, দাবি হোক মানবাধিকারের পক্ষে—কিন্তু ভাষা হোক সংযত, যুক্তি হোক দৃঢ় এবং লক্ষ্য হোক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।
দীপু চন্দ্র দাসের মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দেয়—রাষ্ট্র, সীমান্ত বা ধর্মের ঊর্ধ্বে মানুষের জীবন। এই সত্যকে সামনে রেখে যদি প্রতিবেশী দেশ আত্মসমালোচনা ও সংলাপের পথে এগোয়, তবে ক্ষতি কমবে।


