রাষ্ট্রীয় শিশু স্বাস্থ্য সরকারের জনহিতৈষী বহুবিধ এক প্রকল্প ও এর সুবিধাপ্রাপকরা…

ইকবাল বাহার লস্কর____
বরাক তরঙ্গ, ২৩ জুন : এনএইচএম-র রাষ্ট্রীয় শিশু স্বাস্থ্য (আরবিএসকে) কার্যসুচি। সেটাকে একবাক্যে স্কুল হেল্থ প্রোগ্রাম বলা হয়। এটা কার্যতঃ সরকারের বহুবিধ এক জনহিতৈষী প্রকল্প। এবং, এর সুবিধাপ্রাপকরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। দেশ গড়ার কারিগর। সরকারের এই মহৎ কার্যসুচীর টার্গেট ৬ সপ্তাহ থেকে ১৮ বছর বয়সের শিশু/পড়ুয়া। কেন্দ্রীয় সরকারের এই কর্মসূচির আওতায় প্রতিবছর কয়েক হাজার শিশুদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হয়। চিকিৎসা মানেই এদের জীবন ফেরানো। যে কাজটা করে যাচ্ছে সরকার। কিন্তু এর ফায়দা নিতে এখনো অনেক পিছিয়ে এর সুবিধাপ্রাপক ও অভিভাবকগণ। তাই জনগণের জ্ঞাতার্থে এসব জনহিতৈষী কা্র্যসুচীর বিবরণ প্রাসঙ্গিক বলেই এর পরিসর বৃদ্ধিতে আমার এই অবতারণা।

রাষ্ট্রীয় শিশু স্বাস্থ্য সরকারের জনহিতৈষী বহুবিধ এক প্রকল্প ও এর সুবিধাপ্রাপকরা...
ঠোঁট ও তালুতে ক্রটি থাকা শিশু।

প্রথমতঃ মানুষের অভ্যন্তরীণ অঙ্গের মধ্যে হৃদযন্ত্র হচ্ছে অন্যতম অভিন্ন অঙ্গ। এটার অস্বাভাবিকতা মানেই জীবনের অস্বাভাবিক ছন্দপতন। আর এটা নিস্তেজ মানেই তো জীবনদীপ নিভে যাওয়া। নিভে যাওয়ার বিষয়টি তো ইশ্বর প্রদত্ত বলে আমরা বিশ্বাস করি। বাদবাকি হৃদযন্ত্রে অস্বাভাবিকতার ব্যাপারটি অনেকটা চিকিৎসায় সেরে উঠা যায়। হৃদযন্ত্রে জন্মগত ক্রটি থাকাটা অস্বাভাবিক কোন ব্যাপার নয়। জন্মগত ক্রটি নিয়ে অনেক শিশু জন্মায়। যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় কনজিনিটাল হার্ট ডিজিজ (সিএইচডি)। কিন্তু এই রোগকে জন্মের পর থেকে চিহ্নিত না করাটা একধরনের অস্বাভাবিক বিষয়। অনেক বাবা -মা শিশুর এতো বড় রোগকে অনেক সময় পাত্তা দেন না। শিশুর শারীরিক সুবিধা – অসুবিধাকে অনেকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেন না। খেয়ালের এই অভাবেই একটি শিশু তার স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে। পড়াশুনা, খেলাধুলা ও জীবন যাপনের উপযোগী হয়ে বেড়ে উঠা ইত্যাদি থেকে দূরে চলে যায়। তখন আর কোন প্রচেষ্টা কাজে আসে না এবং একসময়ে অকালে চলে যায়। বরাক তথা কাছাড় জেলায় এই রোগ নিয়ে জন্মানো শিশুর সংখ্যা অসংখ্য। কথায় আছে আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু জন্মগত এই রোগের চিকিৎসা সঠিক সময়ে এবং সঠিক স্থানে  করা না হলে এর ফলাফল একটি পরিবারের ছন্দপতন ঘটে। এই রোগ সঠিক সময়ে করা হলে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব হয়। এই রোগের চিকিৎসা সাধারণতঃ অস্ত্রোপাচারের মাধ্যমে করতে হয়। অনেকটা ব্যয়বহুল এবং অনেক ঝুঁকিপূর্ণ এই রোগের চিকিৎসার খরচ এখন সরকার বহন করে।  গত তিন বছরে কাছাড় জেলার প্রায় দুশো সিএইচডি শিশুর চিকিৎসা করা হয়েছে দেশের প্রথম সারির তথা আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল নারায়না হৃদয়ালয় বেঙ্গালুরু, মুম্বই, কলকাতা কিংবা আমিনগাঁওয়ে। গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) কাছাড়ের ৩৩টি শিশুর সফল চিকিৎসা করা হয়েছে অস্ত্রোপাচারের মাধ্যমে। দেশের এই নামকরা হাসপাতালে প্রথিতযশা চিকিৎসকদের হাতে। নারায়না হৃদয়ালয়ের যেকোন উইনিটে অস্ত্রোপাচার হোক না কেন, অস্ত্রোপাচারের আগে সব মেডিক্যাল রেকর্ড নিজেই খুটিয়ে দেখেন আন্তর্জাতিক মানের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ তথা চেয়ারম্যান ডাঃ দেবীপ্রসাদ শেট্টি। বিশেষ করে সরকারি কর্মসুচীর আওতায় রেফার করা রোগীকে। বিষয়টি কেবল আমার ব্যক্তিগত অভিমত নয়। যারা এযাবৎ চিকিৎসা করিয়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যদের। ফলে এর চিকিৎসার ফলাফল শতকরা হারে একশো’র মধ্যে একশো। দফায় দফায় চিকিৎসার নির্ণয় পুরো নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এই রোগীকে অস্ত্রোপাচারের টেবিলে নেয়া হয়না। এজন্য নারায়না হৃদয়ালেয় আলাদা সুনাম রয়েছে। আমার এই দীর্ঘ কর্মকালে মাত্র এক কিশোর (দেরিতে শনাক্ত হওয়া মতিনগর এলাকার, ১৪ বছরের।) মারা গিয়েছিল বেঙ্গালুরুতে। পরে সেখান থেকে বিমানে তার মরদেহ গুয়াহাটি এবং সেখান থেকে আ্যম্বুলেন্সে করে ওর বাড়ি পাঠানো হয়। যারজন্য ওই পরিবারকে কানাকড়িও খরচ করতে হয়নি। এজন্য  আরবিএসকের রাজ্য পরামর্শক, এনএইচএমের তদানীন্তন উর্ধ্বতন কর্তা এবং গুয়াহাটি মেডিক্যাল কলেজের বর্তমান অধিক্ষক তথা অসম সরকারের সিএইচডি চিকিৎসা কর্মসুচির রাজ্য সংযোজক ডাঃ অভিজিৎ শর্মা এ ব্যাপারে অভূতপূর্ব সহায়তা করেন। সে যাক,
বর্তমানের সুখের কথা হল হৃদযন্ত্রে ফুটো বা অন্য রোগের অস্ত্রোপাচারের ব্যাপারটি যে আরবিএসকে-র  মাধ্যমে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে হয়, তা একবাক্যে বহুল প্রচারিত বলা যায়। এজন্য শিলচর মেডিক্যাল কলেজ তথা জেলার হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা বিশেষ ভূমিকা পালন করছেন। চিকিৎসার ব্যয়বহুলতার (অনুমান ৮ থেকে ১০ লক্ষ টাকা) জন্য তারা আরবিএসকের মাধ্যমে চিকিৎসার পথ ধরিয়ে দেন। তবুও এরমধ্যে স্বল্প সংখ্যক অভিভাবকদের খামখেয়ালীতে কোন শিশু যখন মারা যাওয়ার খবর সামাজিক গণমাধ্যমে চোখে ভাসে তখন মনটা ব্যথিত হয়। কেবল এই নয়, আমার অফিসে অনেকে আসেন। সব বুঝে যান, আবার বেপাত্তা হয়ে যান। পরে অবস্থা বেগতিক হলে আবার অনেকে এসে নানা অজুহাতে পদক্ষেপ নিতে পারেননি বলে জানান। অনেকে এসে এও জানতে চান, তাদের গুয়াহাটি যাবার ব্যবস্থাও কি সরকারিভাবে হবে। মানে যাবার খরচা পাবেন কিনা ? সেই প্রশ্ন যাদের অর্থকরী অবস্থা আছে এবং যাদের নেই তাদেরও। নিজের সন্তানের চিকিৎসার জন্য এই স্বল্প অর্থ কি কোনভাবে পাওয়া যায় ! সেটা অবশ্যই আমার কাছে হাস্যকর।

রাষ্ট্রীয় শিশু স্বাস্থ্য সরকারের জনহিতৈষী বহুবিধ এক প্রকল্প ও এর সুবিধাপ্রাপকরা...
রাষ্ট্রীয় শিশু স্বাস্থ্য কার্যসুচির অধীনে বিভিন্ন স্কুলে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসা।

আসলে সংবিধান প্রদত্ত কল্যাণকামী রাষ্ট্র হওয়াতে আমাদের দেশের একাংশ মানুষ কর্মবিমুখ হয়েছেন। ‘মাগনা’ খেয়ে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই যেখানে যে সুযোগ থাকে,সেটা পেতে চায় বিনা দ্বিধায়। প্রসঙ্গত, শনাক্ত হওয়া এই ধরনের রোগী এবং সঙ্গে একজন অভিভাবক (আ্যটেনডেন্ট)-এর গুয়াহাটি থেকে বিমান ( মুম্বই, কলকাতা, বেঙ্গালুরু) ভাড়া (বিমানের টিকিট তারাই করে) সহ সেখানে থাকা, খাওয়া, পরীক্ষা-নীরিক্ষা, অস্ত্রোপাচার ও ওষুধপত্র সহ চিকিৎসার যাবতীয় খরচ আরবিএসকের অধীনে বহন করা হয়। সরকারের এই উদারতার সঙ্গে সামান্য সৌজন্যবোধটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছেন মানুষ। তাঁর চাইতেও বড্ড বেদনাদায়ক কথা হলো, বেশিরভাগ মানুষ সফল অস্ত্রোপচার করিয়ে বাড়িতে আসেন, কিন্তু একটি বারও জানান না। যার মাধ্যমে গেলেন, তার প্রতি  এতো অকৃতজ্ঞতা, ভাবতে কষ্ট হয়। তবুও কর্ম তো করতে হয়। জেলায় এই কর্মযজ্ঞে যারা জড়িত, চিকিৎসক, নার্স সহ অন্যান্যরা, তারা সেটার তোয়াক্কা না করেই  কাজ করে যাচ্ছেন নিরলস।

রাষ্ট্রীয় শিশু স্বাস্থ্য সরকারের জনহিতৈষী বহুবিধ এক প্রকল্প ও এর সুবিধাপ্রাপকরা...
আইএফএ ও কৃমিনাশক ট্যাবলেট খাওয়ানোর দৃশ্য।

এবারে আসি, একই প্রকল্পের অধীনে আরো কিছু জনহৈতিষী কার্যসুচীর প্রাসঙ্গিক বিবরণ নিয়ে। প্রসঙ্গত রাষ্ট্রীয় শিশু স্বাস্থ্য কার্যসুচির অধীনে এখন ৬ মাস থেকে ১৮ বছর বয়সের প্রায় ৪৯ টি রোগের চিকিৎসা বিনামূল্যে করা হয়। বিশেষ করে অঙ্গনওয়াড়ি ও  সরকারি স্কুলের তালিকাভুক্ত শিশুদের। এছাড়াও রয়েছে জন্মগত অনেক ক্রটির চিকিৎসা। কিছু কিছু জন্মগত ক্রটি রয়েছে যেগুলোর চিকিৎসায় সাড়া পাওয়া যায় না। তবে এসবের মধ্যে যেগুলোর চিকিৎসায় ভালো রেজাল্ট পাওয়া যায় এবং চিকিৎসার পর এই শিশু তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। সমাজের সঙ্গে সমানতালে চলাচল করতে সক্ষম হয়। কিন্তু কিছু অভিভাবক চিকিৎসার পথে না হেঁটে বরং একটি প্রতিবন্ধী সংশাপত্র জোগাড় করার বাসনায় থাকেন। সংশাপত্র দিয়ে যাতে সরকারি সুযোগ সুবিধা লাভ করা যায়। তাতে যে স্বাভাবিক একটি শিশুর ভবিষ্যত প্রতিবন্ধী বানিয়ে দিতে তাদের বিবেকে বাঁধে না। এরমধ্যে আবার কুসংস্কারও আছে। যেমন ঠোঁট ও তালুতে ক্রটি থাকা বা পা বাঁকা (ক্লাবফুট) শিশুর চিকিৎসায় কুসংস্কার। এটাকে ভগবানের দান বলে এর চিকিৎসা করাতে চান না। ধরুন একটি শিশুকে দেখার মধ্যে কোন ক্রটি নেই। তবে তালুতে সামান্য ছেদ (ক্লেফট পেলেইট) রয়েছে। এই ছেদের কারণে তাঁর কথাগুলো কখনো পরিস্কার হয় না। খাওয়া দাওয়ার ক্ষে্ত্রেও এধরনের শিশুর অনেক অসুবিধা হয়। এই ধরনের একটি শিশু স্কুলে তার সহপাঠীদের সঙ্গে কখনো মিশতে পারবে না। নিজেকে সবসময়েই হেয় প্রতিপন্ন করে ভাবতে থাকে। কিন্তু এই শিশুর সামান্য একটি অ্স্ত্রোপাচার হয়ে গেলেই আর কোন বাঁধা বা বিভেদ থাকবে না। এটুকুও অনেক অভিভাবক বুঝেন না। এই ক’দিন আগে এধরনের এক মা তাঁর অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া এক ফুটফুটে মায়াবী কন্যাকে নিয়ে আসেন প্রতিবন্ধী সার্টিফিকেট বানাতে। শিলচরের এক বেসরকারি স্কুলের প্রধান নাকি বলেছেন তার জন্য সার্টিফিকেট বানিয়ে নিতে। অফিসের সংস্লিষ্ট কর্মীর কাছে যখন আসেন, উনি তখন আমার কাছে পাঠিয়ে দেন। আমার দেখে ভীষণ খটকা লাগলো। বললাম এটা ঠিক হওয়ার জন্য সামান্য একটা সার্জারি (প্লাস্টিক সার্জারি) লাগবে। যদিও ব্যয়বহুল তবে সেটা হবে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। এতো ভালো একটি মেয়েকে কেন প্রতিবন্ধী বানাবেন। সেটা করিয়ে নেন,আমি যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেবো। পাশে বসা আমার এক সহকর্মীও তাঁকে বোঝানোর কোন ক্রটি রাখেনি। আশ্চর্য, এতোসবের পরে মায়ের জবাব সেটা নাকি ভগবানের দান। উনার শ্বাশুড়ি মা সেটাকে ভগবানের দান বলে বহুদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন। উনার নাকি খুব আদরের নাতনি সে ! তাই তিনিও তাতে অনড়। নাম ঠিকানা থাকায় ওদের বাসায় আশাকর্মী পাঠিয়েও লাভ হয়নি। ঠোঁট ও তালুতে ক্রটি থাকা চা বাগানের অনেক অভিভাবক এর চিকিৎসায় অনিহা প্রকাশ করেন। গত অর্থবছরে এধরনের ৩৬টি শিশুর চিকিৎসা করা হয়েছে। সে যাক, পা বাঁকা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করা শিশুর চিকিৎসায় কুসংস্কার অনেকটা কাজ করে। ভগবানের দেয়া বলে সেটা অনেকে না করে অন্য পন্থায় হাঁটেন এবং সারা জীবনের শিশুকে পঙ্গু করে তুলেন। অথচ জন্মের পরপরই এই শিশুর চিকিৎসা করা হলে সহজেই সে সাধারণ মানুষের মতো হতে পারে। তাও বিনামূল্যে রাষ্ট্রীয় শিশু স্বাস্থ্য কার্যসুচির অধীনে হতে পারে। কিন্তু এটা জন্মের পর (Newborn) হলে সেটা সম্ভব হয়। সে সময়ে কেবলমাত্র প্লাস্টারের মাধ্যমে হয়ে থাকে। শিশু বড় হয়ে গেলে এর জন্য অ্স্ত্রোপাচার করাতে হয়। তবে সেটা অনেকক্ষেত্রে অসফলও হতে পারে। গত অর্থবছরে এধরনের ২০টি শিশুর সফল চিকিৎসা হয়েছে।

রাষ্ট্রীয় শিশু স্বাস্থ্য সরকারের জনহিতৈষী বহুবিধ এক প্রকল্প ও এর সুবিধাপ্রাপকরা...
আইএফএ ও কৃমিনাশক ট্যাবলেট খাওয়ানোর দৃশ্য।

শিশুদের জনহিতৈষী আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প রয়েছে সেটাকে উইফস (WIFS) বলা হয়।পুরো অর্থ উইকলি আয়রণ ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্টেশন। এর আওতায় সপ্তাহে একটি করে আইএফএ বড়ি খাওয়ানো হয়। এই বড়ি আদতে কোন ওষুধ হিসেবে ধার্য নয়। সেটাকে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের এক পরিপূরক (সাপ্লিমেন্টেশন) হিসেবে ধার্য করা হয়। ৫ থেকে ১০ বছর বয়সের কম এবং ১০ থেকে ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত দুটি স্তরে স্কুল পড়ুয়া ছেলে ও মেয়েদের জন্য স্কুলে এবং স্কুলছুট মেয়েদের জন্য অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের মাধ্যমে সেটা প্রদান করা হয়ে থাকে। ৫-১০ বছর বয়সের শিশুদের জন্য গোলাবি রংয়ের আইএফএ বড়ি (IFA Tab) এবং ৯-১৯ বছর বয়সের কিশোর কিশোরীদের নীল রঙের আইএফএ বড়ি প্রদান করা হয়ে থাকে।
এই ওষুধের গুণাগুণ অনেক। এর কয়েকটির মধ্যে রয়েছে –
১) শিশুর শরীরে রক্তাল্পতা প্রতিরোধ করে। এরজন্য স্কুল পড়ুয়াদের ক্লান্তি, খারাপ মেজাজ, শ্বাসকষ্ট, ইত্যাদি দূর করে।
২) আয়রন প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি ক্ষতিগ্রস্থ কোষ, টিস্যু এবং অঙ্গগুলিতে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ায়। এছাড়াও, বিভিন্ন সংক্রমণের সাথে লড়াই করে রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
৩) পড়ায় মনোযোগ (ফোকাস) এবং একাগ্রতা উন্নত করে। স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধি পায় (ব্রুনোলিয়ার প্রয়োজন হয় না)।

রাষ্ট্রীয় শিশু স্বাস্থ্য সরকারের জনহিতৈষী বহুবিধ এক প্রকল্প ও এর সুবিধাপ্রাপকরা...

৪) শক্তি বাড়ায়। দেহে যত বেশি আয়রন থাকবে তত বেশি শক্তিশালী বোধ করবে পড়ুয়ারা।  যা শারীরিক এবং মানসিক উভয় কার্যকারিতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৬) পেশী শক্তি বৃদ্ধি করে
পর্যাপ্ত পরিমাণ আয়রন দেহের পেশীগুলির শক্তি ও স্থিতিস্থাপকতার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহ করে। এটি খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স আরও ভাল করতে সহায়তা করে।
৭) শরীরের ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে।
ফলিক এসিডের অভাবে কি হয়
১. ক্লান্তিভাব।
২. চুল ধূসর হয়ে যাওয়া।
৩. মুখে ঘা।
৪. জিহ্বা ফুলে যাওয়া।
৫. চামড়া ফ্যাকাশে হওয়া।
৬. শরীরের বৃদ্ধিতে সমস্যা ইত্যাদি।
এদিকে, কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে যা রোগীকে প্রভাবিত করতে পারে:
বমি বমি ভাব (Nausea)
পেটে খিঁচুনি (Abdominal Cramp)
কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation)
এপিগ্যাসট্রিক ব্যাথা (Epigastric Pain)
ডায়রিয়া (Diarrhoea)
আয়রন ট্যাবলেট মল কালো করতে পারে। মনে রাখবেন, এসব নিরীহ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এবং কোন চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না।
তবে এই বড়ি কখনো দুধের সঙ্গে, খালি পেটে খেতে নেই।

রাষ্ট্রীয় শিশু স্বাস্থ্য সরকারের জনহিতৈষী বহুবিধ এক প্রকল্প ও এর সুবিধাপ্রাপকরা...
রাষ্ট্রীয় শিশু স্বাস্থ্য কার্যসুচির অধীনে বিভিন্ন স্কুলে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসা।

সরকারের আরেকটি জনহৈতিষী প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে জেলায় জেলায়
পুষ্টি পুনর্বাসন কেন্দ্র ( Nutritional Rehabilitation Centre (NRC)) গড়ে তোলা । দেশ তথা আসামের প্রায় জেলা হাসপাতালে এরকমের স্বয়ং সম্পূর্ণ চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে। আমাদের শিলচর সিভিল হাসপাতাল চত্বরে এরকমের একটি চিকিৎসা কেন্দ্র রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য অভিযানের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। আসামের অন্যান্য জেলার চাইতে অনেক ভালো পরিসেবা দিয়ে আসছে এখানকার এনআরসি। এখানে নিয়ম অনুযায়ী ৬ মাস থেকে ৫ বছর কম বয়সের  শিশুদের আরবিএসকে, বিভিন্ন হাসপাতালের ওপিডি, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, আশাকর্মী বা ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার এর মাধ্যমে  নিয়ে আসা হয়। আরবিএসকে- র মাধ্যমে শিশুদের বাড়ি থেকে ১০৮ আ্যম্বুলেন্স কিংবা প্রয়োজন সাপেক্ষে আরবিএসকে-র নিজেদের গাড়ি দিয়ে এনআরসি-তে নিয়ে আসা হয়। কেন্দ্রে নিয়ে আসার পর শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রাতিষ্ঠানিক সেবা প্রদান করা হয়। এরমধ্যে রয়েছে শিশুর জন্য পুষ্টিকর আহার তৈরি করে সময়ে সময়ে খাওয়ানো, যাবতীয় ওষুধ ও পরীক্ষা- নিরিক্ষা (হাসপাতালে ওষুধ ও নীরিক্ষা বা টেস্টের যোগান না থাকলে সেটা বাইরে করানোরও সংস্থান রয়েছে) ছাড়াও সঙ্গে থাকা তার মায়ের খাওয়া-দাওয়া যা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। কেবল তাই নয়, যতদিন মা এই হাসপাতালে থাকবেন ততদিন পারিতোষিক হিসেবে দিনে দু’শো টাকা করে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে দেয়া হয়। স্বাভাবিক অপুষ্টিতে ভুক্তভোগী শিশুর ১৫ দিনে তার ওজন বেড়ে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে সক্ষম হয়। আর এই ১৫ দিনে রোগীর অভিভাবক পেয়ে গেলেন ৩হাজার টাকা। অবশ্য কেন্দ্রে ১৫ দিন বা এর উপরে থাকাটা নির্ভর করে শিশুর স্বাভাবিক সুস্থতা, চিকিৎসকের পরামর্শের উপর। তবে যতদিন শিশু থাকবে ততদিন পারিতোষিক সে হিসেবেই থাকছে।

রাষ্ট্রীয় শিশু স্বাস্থ্য সরকারের জনহিতৈষী বহুবিধ এক প্রকল্প ও এর সুবিধাপ্রাপকরা...

এই কেন্দ্রে হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ছাড়াও ডায়েটিসিয়ান (না থাকলে সে স্থলে অভিজ্ঞ সেবিকারা), নার্সিং স্টাফ, রাঁধুনি, কেয়ার টেকার রয়েছেন। তাছাড়া শিশুর জন্য খেলার আসবাব, শিশুর মনোরঞ্জনের জন্য টেলিভিশনের মাধ্যমে কার্টুন, ছড়া, ছবি, গান ইত্যাদি শিক্ষণীয় বস্ত। বলা বাহুল্য, এতোসব সুবিধা থাকা সত্ত্বেও আমাদের সমাজ এখনো এসবের সুবিধা নিতে অনেক দূরে। যারা পাঠক, তাদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ। এসব সুবিধার বহুল প্রচারের জন্য। আর এই প্রচারের ফলে যদি একটি শিশু তার জীবনের মূল ছন্দ খুঁজে পায়, তাহলে বুঝব সমাজের দায়িত্ববান নাগরিকদের সার্থকতা, আমার এই লেখনির সার্থকতা।
লেখক: রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য অভিযানের কাছাড় জেলার বিভাগীয় (স্কুল হেল্থ) জেলা সংযোজক। ফোন ৯৪৩৫২৭৬২২৯

Author

Spread the News