অসুস্থ মাকে কেউ সমঝে নিল না, বাড়ির গেটে ঝুালালো তালা, গ্রেফতার ২ ছেলে

বরাক তরঙ্গ, ২২ নভেম্বর : হাইলাকান্দিতে এক অমানবিক ঘটল। শহরে এমন লজ্জাজনক ঘটনায় নিন্দা ঝড় শুরু হয়। দুই সরকারি চাকরিরত দুই সন্তানের কাছে জন্মদাত্রী বোঝা হয়ে গেলেন।

বৃদ্ধ মাকে অবহেলা করে ফেলে রাখলো গেটের বাইরে। বুধবার এধরণের দুই ‘গুণধর’ সন্তানের অমানুসিক ঘটনার সাক্ষী হল শহর হাইলাকান্দি। বৃদ্ধা অসুস্থ মাকে বাড়ির বাইরে রেখে দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিলেন দুই সন্তানে। জন্মদাত্রী মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে অবশেষে পুলিশের হাতে আটক হল দুই ভাই। দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন জেলা আয়ুক্ত কার্যালয়ের কর্মী অলোক নাথ ও শিক্ষক অনুপ নাথ।

জানা যায়, দীর্ঘ বছর থেকে হাইলাকান্দি শহরের রবীন্দ্র সরণি এলাকায় নিজের দুই ছেলের সঙ্গে বসবাস করতেন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা জয়া নাথ। তার বড় ছেলে অলোক নাথ হাইলাকান্দি জেলা আয়ুক্ত কার্যালয়ে কর্মী আর ছোট ছেলে অনুপ নাথ স্কুল শিক্ষক। জয়া নাথের দুই মেয়েও আছেন। আর দু’জনই বিবাহিত। একজনের বাড়ি হাইলাকান্দি শহরেই, আর অন্যজন শিলচরে৷ গত প্রায় দশ বছর আগে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন জয়া নাথ। এরপর থেকে দুই ছেলে, বৌ, নাতি নাতনি সহ থাকতেন রবীন্দ্র সরণির বাড়িতে। কিন্তু বুধবার সন্ধায় তাদের প্রতিবেশী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা দেখতে পান বৃদ্ধা জয়া নাথ একটি অ্যাম্বুলেন্সের বেডে শুয়ে আছেন সঙ্গে তার ছোট মেয়ে। আর তাদের বাড়ির গেটে তালা ঝুলানো।  বাড়ির মানুষ ঘরের ভেতরে থাকলেও কারও ডাকাডাকিতে সারা দিচ্ছেন না। ধীরে ধীরে গেটের বাইরে মানুষ জড়ো হতে থাকে। শুরু হয় হৈ হট্টগোল। খবর নিয়ে জানা যায়,  সত্তোর্ধ বৃদ্ধা জয়া নাথ দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থ। কিন্তু এই বয়সে অসুস্থ হলে তার ছেলেরা তাকে তেমন চিকিৎসা করাতেন না বলে অভিযোগ। তাই মায়ের উন্নত চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসেন তার হাইলাকান্দিতে থাকা বড় মেয়ে। বড় মেয়ে তার মাকে বাড়িতে রেখে বেশ কিছুদিন চিকিৎসা করেন। তবে শারীরীক অবস্থার তেমন পরিবর্তন না হলে শিলচরস্থিত  তার ছোট মেয়ে মাকে নিয়ে যান উন্নত চিকিৎসার জন্য। শিলচরে প্রথমে একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে ও পরে ছোট মেয়ের বাড়িতে থেকে চিকিৎসা হয় বৃদ্ধা জয়া নাথের। এবার একটু সুস্থ হলে নিজের বাড়িতে ফিরে আসার জেদ করেন তিনি। আর তাই বুধবার অ্যাম্বুলেন্স করে শিলচর থেকে হাইলাকান্দির রবীন্দ্র সরণির বাড়িতে অসুস্থ মাকে নিয়ে আসেন। আর এতেই ঘটে বিপত্তি। দুই ছেলে কিছুতেই মাকে বাড়িতে রাখতে রাজি না।

এদিন বিকেল আনুমানিক চারটা নাগাদ শিলচর থেকে অ্যাম্বুল্যান্সে করে বৃদ্ধা মাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন ছোট মেয়ে। কিন্তু বাড়ির সামনে আসতেই দুই ছেলে জন্মদ্বাত্রী মাকে সমঝে নিতে অস্বীকার করেন।
বাড়িতে প্রবেশের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয় যাতে অসুস্থ মাকে নিয়ে কেউই বাড়িতে প্রবেশ না করেন। বিকেল চারটা থেকে রাত সাড়ে সাতটা পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা বাড়ির সামনে অ্যাম্বুল্যান্সে পড়ে থাকতে হয় অসুস্থ বৃদ্ধা মাকে। দুই ছেলের মধ্যে কেউই এগিয়ে আসেননি অসুস্থ মাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে। এখানেই শেষ নয়, তারা এই বৃদ্ধাকে চিনেন না, কখনও দেখেননি বলেও মন্তব্য করেন। এভাবে প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা অ্যাম্বুল্যান্সে পড়ে থাকতে দেখে প্রতিবেশী সহ স্থানীয় দোকানি এর প্রতিবাদে গর্জে উঠেন।‌ অলোক ও অনুপ দুই ভাইয়ের বাড়ির সামনে ভিড় জমতে থাকে। মুহুর্তের মধ্যে শতাধিক লোক জমায়েত হয়ে বৃদ্ধা মাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে বলেন দুই ছেলেকে। কিন্তু প্রতিবেশি, দোকানি সহ স্থানীয় নাগরিকদের কথায় তারা কর্ণপাতই করেননি। উল্টো তিনি তাদের মা নয় বলে সাফ জানিয়ে দেন দুই ছেলে। খবর পেয়ে দলবল নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন বিজেপির মহিলা মোর্চার জেলা সভানেত্রী অনামিকা আচার্য। তিনি  বিষয়টি তৎক্ষণাত অবগত করেন জেলা আয়ুক্তকে। স্থানীয়য়রা খবর দেন হাইলাকান্দি সদর থানায়। পরে জেলা আয়ুক্ত নিসর্গ হিভারে গৌতমের নির্দেশে হাইলাকান্দির সদর সার্কল অফিসার ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। ততক্ষনে সদর থানার ইন্সপেক্টর ওসি রাজেন রংমাই বিশাল পুলিশ সিআরপিএফ দল নিয়ে রবীন্দ্র সরণির অলোক নাথ ও অনুপ নাথের বাড়িতে ছুটে আসেন ।

এদিকে, হৃদয়বিদারক এহেন ঘটনা সহ অসুস্থ মাকে সমঝে নিতে  পুত্রদের অস্বীকার করায় বেজায় চটেন স্থানীয়রা। তারা এধরনের কুলাঙ্গার পুত্রদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবি করেন। অবশেষে ম্যাজিস্টেটের হস্তক্ষেপে ও পুলিশের  তৎপরতায় অ্যাম্বুল্যান্সে থেকে বৃদ্ধাকে নামিয়ে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন রাত আনুমানিক সাড়ে সাতটা। দুই ছেের তাদের জন্মদ্বাত্রী মাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে অস্বীকার করায় ক্ষোভে ফুঁসেন স্থানীয়রা। তারা ম্যাজিস্টেট ও পুলিশের সামনে এধরনের এই কুলাঙ্গার পুত্রদের গ্রেফতারের জোর দাবি জানান। পরে অবশ্য সদর থানার পুলিশ অলোক নাথ ও অনুপ নাথকে থানায় নিয়ে যায়।

Author

Spread the News