পুরনো কাপড়ের বিনুনিতে সুদৃশ্য শিল্পকর্ম গণেশ নন্দীর, প্রভূত সাড়া দেশ-বিদেশে
মৃত্যুঞ্জয় দাস____
২৩ নভেম্বর : ‘পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না। কিন্তু যে ই আঁকুক সে ছবিই আঁকে। অর্থাৎ যাহাকিছু ঘটিতেছে, তাহা অবিকল নকল রাখিবার জন্য সে তুলি হাতে বসিয়া নাই। সে আপনার অভিরুচি অনুসারে কত কী বাদ দেয়, কত কী রাখে। কত বড়োকে ছোটো করে, ছোটোকে বড়ো করিয়া তোলে। সে আগের জিনিসকে পাছে ও পাছের জিনিসকে আগে সাজাইতে কিছুমাত্র দ্বিধা করে না। বস্তুত তাহার কাজই ছবি আঁকা, ইতিহাস লেখা নয়।‘ কবিগুরুর এই স্তবক থেকে একটু বেরিয়ে বলতে দ্বিধা নেই যে, তবুও শিল্পীর সৃষ্টি একদিন ইতিহাস হয়ে ওঠে। ‘জীবনস্মৃতি’-র প্রারম্ভেই রবিঠাকুর যে দিকনির্দেশ দিয়েছেন, তার আগাগোড়াই শিল্পীর স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা নিয়ে। সৃজনশীলতায় নিমগ্ন মানুষের বোধের ওপর। প্রথাগত শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত হয়েও ফর্ম ভাঙার মানসিকতা বা নয়া আঙ্গিকে সাধারণ বিষয়গুলোকে তুলে ধরার কাজে ইতিমধ্যেই বরাকের মানচিত্র তো বটেই সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পেরিয়ে খ্যাতি ও তাঁর শিল্পের আঙ্গিক নিয়ে উৎসাহ ছড়িয়েছে। তিনি আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্যকলা বিভাগের বিভাগের সহকারী অধ্যাপক গণেশ নন্দী।
আসলে ২০২০-এ বিশ্বজোড়া করোনা অতিমারিকালে একদিকে রোগের আক্রমণে ও ত্রাসে মানুষকে বহুদিক থেকে ফিরিয়ে রেখেছে। লকডাউনের গৃহবন্দি মানুষের অনেককেই কুঁড়ে করে তুলেছে। আবার অনেকে নেই কাজের দিনগুলোতে শুধু খৈ ভেজেই গেছেন। তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ আবার নিমগ্ন থেকেছেন নিজের সৃষ্টির কাজে। নতুন ভাবনা, নতুন আঙ্গিক নিয়ে অনেকেই মাথা কুটেছেন বন্ধ ঘরে। গণেশও ঠিক সেই মাথা কুটোকুটিতে তো ছিলেনই, আর ছিলেন বলেই সেই অবকাশকে পুরোদস্তুর সদ্ব্যবহার করে গেছেন। যার নির্যাস পুরনো কাপড় দিয়ে বিনুনি বানিয়ে ভাস্কর্য সৃষ্টি। বিষয়টি নেহাত সহজ তো নয়ই, বস্তুত হস্তশিল্পের দুনিয়ায় নবতম সংযোজন। এ নিয়ে আঞ্চলিক, জাতীয় বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও চ্যানেল যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ, সাক্ষাৎকার, নিবন্ধ ইত্যাদি প্রকাশ করেছে। প্রদর্শনী ও কর্মশালার জন্য দেশবিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তাঁকে। প্রত্যেকেই নয়া শিল্পকলা নিয়ে জানতে আগ্রহী। এমনকী, এসব বিক্রি বা নিলামের জন্যও অফার আসছে তাঁর কাছে। সেই তালিকায় এশীয় দেশ ছাড়াও ইউরোপ, দক্ষিণ আফ্রিকা রয়েছে। কিন্তু এবার সেই আঙ্গিককে ভিত্তি করেই জন্ম গণেশ সৃষ্টি করলেন আরেক নয়া জগত।এবার আর বিনুনি বানিয়ে ত্রিমাত্রিক বা থ্রি-ডাইমেনশন নয়, দ্বিমাত্রিক অর্থাৎ টু-ডাইমেনশন। তাঁর কথায়, এটি শিল্পদুনিয়ায় নতুন আঙ্গিক।
গণেশ জানান, শিল্পের কোনও বাঁধাধরা নিয়ম নেই। তাই নিয়মের গৎবাঁধা জগতের বাইরে বিচরণে তাঁর প্রব্রজ্যা। নয়া এই আঙ্গিককে তিনি বলতে চান, ‘নিউ মিডিয়া পেইন্টিং’। আগেরটা ছিল রংবেরঙের পুরনো কাপড় দিয়ে বিনুনি বানিয়ে অনেকটাই পাপোস বা ডোরম্যাট জাতীয় জিনিসের মতো। যেখানে দেখা গেছে খাঁচাবন্দি মানবশিশু ও খাঁচার বাইরে পাখি। যেন শিশুগুলো বাইরে বেরনোর ‘শকতি’-র অন্বেষে! এভাবেই জীবজন্তু বা অন্যান্য কিছুর অবয়ব। সেবার এসব নিয়ে শিল্পীমহলে প্রচুর সাড়া পড়ে। এরপর সেই পুরনো নানা রঙের কাপড়ের বিনুনি দিয়েই কাজ। তবে আগেরবারের মতো ত্রিমাত্রিক নয়। সেই ফর্ম থেকে কিছুটা বেরিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে ক্যানভাস। সেই ক্যানভাসে আঠা দিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়েছে বিনুনি-জাত শিল্পকর্ম। কি নেই এর মধ্যে ? এ পর্যন্ত ষোলোটি শিল্পকর্মের মধ্যে বরণীয়-স্মরণীয় মহামানব থেকে শুরু করে পশুপাখি, প্রকৃতি। সে সঙ্গে রয়েছে সময়ের ছাপ। সমকালীন ভাবনাজাত শিল্পের নির্যাস যেমন ‘গিরগিটি’।
দেখা যাচ্ছে, একটা কুর্সির কাঁধে গিরগিটির দৃপ্ত ভঙ্গিমায় বসে থাকা। কুর্সিবিলাসী বা ক্ষমতালোলুপ রাজনীতির প্রতিনিধিত্বকারী এই শিল্পকর্ম। আরেকটিতে ফুটে উঠেছে সবুজ চা বাগিচায় বুলডজারের হানা। গ্রিনফিল্ড এয়ারপোর্ট নির্মাণের নামে গেল বছর ডলু চাবাগানে চারাগাছ উপড়ে ফেলার কথা মনে করিয়ে দেয় এই কাজ। এরকম রয়েছে জুমখেত, ট্রিউলিপ, উদ্যানচাষ,নগর সভ্যতা ও প্রাচীনের দ্বন্দ, আকাশ থেকে দৃশ্যমান ফসলভরা মাঠ, বুকশেল্ফ, মোরগ ইত্যাদি। এ ছাড়াও রয়েছে রবীন্দ্রনাথ, ভূপেন হাজরিকার মতো মনিষীর প্রতিকৃতি। দৃষ্টিনন্দনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোনটাকেই বাদ দিয়ে আলাদা ‘সুন্দর’ বলার অবকাশ নেই গণেশের এসব সৃষ্টিতে।
কথা হচ্ছিল করোনাকাল নিয়ে।
এই অতিমারী যে সৃষ্টির পথ আকীর্ণ করে রাখতে পারেনি, তা সেই সময় ঘরে বসে নাচ-গান-নাটকের লাইভ থেকে শুরু করে ঘরকন্নার কাজ, স্বাদু রেসিপি ইত্যাদিতে প্রমাণিত। কিন্তু সেই দুঃসময়কে সুসময় করে না তুললেও নিজের আর্তি ও আকুলতা থেকে সৃষ্টির উপযুক্ত পরিবেশ হিসেবে সদ্ব্যবহার করলেন চিত্রকর গণেশ নন্দী। নয়া কৌশল সম্পর্কে বলতে গিয়ে গণেশ জানান, পুরনো কাপড় এজন্যই কারণ এগুলো দিয়ে বেণী বাঁধা সহজ। তবে অন্যান্য কাপড় থেকে এক্ষেত্রে সুতি কাপড়েই বেশি সুবিধা। তবে তাঁর কিছু কাজে সিন্থেটিক কাপড় ব্যবহার করলেও ক্যানভাসে সেঁটে নেওয়ার জন্য সুতি কাপড়েই সুবিধা। তাছাড়া পুরনো কাপড়চোপড় পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে দেওয়া কিংবা বাসনকোসন কেনা থেকে একটা ভিন্ন ভাবনায় সেগুলোকে ব্যবহার করার হাত ধরেই এই শিল্পের জন্ম। কিন্তু এমনিতে পুরনো বস্ত্র প্রায় সবার ঘরে ডাই করে রাখা থাকলেও কাজের সময় হাতের কাছে পাওয়া মুশকিল। অতএব এ ঘর- ও ঘর করে পাড়াপড়শির কাছ থেকেও কাপড় সংগ্রহ করতে হয় তাঁকে। কিন্তু এত এত বিনুনি বাঁধা চাট্টিখানি কথা ?
এ কাজে শিল্পীর সহযোগী শুরুর দিকে সহধর্মিণী মাম্পি বৈদ্য এগিয়ে আসেন। কিন্তু দুই সন্তানের দেখভাল ও বেণী বাঁধার মধ্যে সেতু গড়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি বেশিদিন। এগিয়ে এলেন গণেশের মা কল্যাণী নন্দী। গণেশের এই কাজের বেশিরভাগ বেণী বানিয়ে দিয়েছেন এই প্রবীণা। পুরনো শাড়ি, নাইটি ইত্যাদির কাপড় দিয়েই একের পর এক কাজ করে যান গণেশ। এই সৃষ্টির গুরুত্ব, মূল্য বা প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে গণেশের বক্তব্য, হস্তশিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা বিষয় নিয়ে কাজ করতে উৎসাহিত ও উপকৃত হবেন। কারণ, এরকম কৌশল আগে ব্যবহার হয়নি। তাঁর এই ‘নিউ মিডিয়া পেইন্টিং’ আগের ধাঁচে ট্রাপস্ট্রি নয়।আগে যেমন ডোরম্যাট বা পাপোস বানাতে বিনুনিগুলোকে সুতো দিয়ে সেলাই করতে হত। এটা ক্যানভাসে ছবি, কিন্তু আঁকা নয়, বেণী বেঁধে নানা রূপ দিয়ে তা ক্যানভাসে আঠা দিয়ে সেঁটে দেওয়া। নেট সার্চ করেও এই মাধ্যম বা কৌশলের হদিশ পাওয়া যাবেনা বলে জানান গণেশ।
করোনা অতিমারির সময় আবিষ্কৃত বা উদ্ভাবিত এই নতুন দু’টি শিল্প আঙ্গিক নিয়ে রবিঠাকুরকে ধার করে গণেশ বলেন,’সৃষ্টির জন্য চাই অবকাশ’। পৃথিবী রোগমুক্ত হোক। কিন্তু তাঁর কথা ধরেই বলা যায়, এরকম অবকাশ আসুক বারবার। সৃষ্টি হোক নতুন শিল্পভাবনা, আঙ্গিক এবং শিল্পের অভীষ্ট পূরণকারী সিদ্ধিদাতা হয়ে উঠুন গণেশ নন্দী। সৌজন্যে : দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ।