সোনাই কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ তজমুল আলি মজুমদার আর নেই
বরাক তরঙ্গ, ২৬ ডিসেম্বর : সোনাই এমসিডি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হাজি তজমুল আলি মজুমদার (পটল) আর নেই। বৃহস্পতিবার সকাল ৫-৫০ মিনিটে সোনাই রাঙ্গিরঘাটে নিজ বাসভবনে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। সন্ধ্যে সাড়ে পাঁচটায় সোনাই এনজি স্কুল মাঠে জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হবে। রেখে গেছেন স্ত্রী, এক ছেলে, দুই মেয়ে, অসংখ্য ছাত্রছাত্রী, গুণমুগ্ধদের।
বৃহত্তর সোনাই এলাকায় শিক্ষার আলোকবর্তিকা হিসেবে সুপরিচিত প্রয়াত মজুমদার। সোনাই উত্তর মোহনপুরে এক অভিজাত পরিবারে ১৯৪৯ সালের ১৪ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম মছদ্দর আলি মজুমদার। মায়ের নাম আজিবুন নেছা মজুমদার। সোনাই মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তজমুল আলির প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি। পরে ভর্তি হন সোনাই নিত্যগোপাল হাইস্কুলে। স্নাতক অবধি পড়াশোনা শিলচর গুরুচরণ কলেজে। তখন শিলচরের সঙ্গে সোনাইর যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত ছিল না। তাই কলেজের পাশেই কয়েকজন মিলে একটি মেস করে থাকতেন। জিসি কলেজ থেকে কলা বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি গ্রহণ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি গ্রহণের স্বপ্ন নিয়ে তজমুল আলি ১৯৬৯ সালে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর ইচ্ছে করলে তজমুল আলি মজুমদার কোনও কলেজের অধ্যাপক কিংবা সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সরকারি চাকরির পেছনে দৌড়াদৌড়ি না করে বৃহত্তর সোনাই এলাকার ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার জন্য কীভাবে একটি কলেজ খোলা যায়, তা নিয়ে চিন্তা করলেন। এ নিয়ে তিনি অনেকের সঙ্গে যোগাযোগও করেন। সেই সময়ে ময়ীনুল হক চৌধুরী বরাক তথা অসমে কংগ্রেসের অবিসংবাদিত নেতা। তিনিও কংগ্রেস পরিবারের লোক। দেখা করলেন ময়ীনুল হক চৌধুরীর সঙ্গে। ময়ীনুল হক অবশ্য তাঁকে উৎসাহিত করলেন। ময়ীনুল হকের আশীর্বাদ নিয়ে তজমুল আলি মজুমদার সোনাই এলাকায় উচ্চশিক্ষার বিস্তারে একটি কলেজ স্থাপন করেন।
সোনাই এলাকার সে-সময়ের আরেক জনপ্রিয় ব্যক্তি ডাঃ ইলিয়াস আলি লস্করকে কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি নির্বাচিত করে সোনাই এনজি স্কুলে মর্নিং শিফটে মাত্র কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্রকে নিয়ে কলেজের যাত্রা শুরু হয়। অবশ্য ওই সময় তাঁর পাশে দাড়ান তৎকালীন বিধায়ক নুরুল হক চৌধুরী, ডাঃ সুষেণ নাথ, ডাঃ রুক্মিণী নাথ, রবিজুল আলি লস্কর, শিক্ষাবিদ ইয়ামিন আলি লস্কর, গুলেজর আলি মজুমদার, সে-সময়ের পঞ্চায়েত আসক আলি, প্রাক্তন বিধায়ক শুভঙ্কর সিংহ প্রমুখ। তৎকালীন সোনাই এনজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হামিদ আলি চৌধুরী স্কুলে মর্নিং শিফ্টে অস্থায়ীভাবে কলেজের ক্লাস চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেন। বছর দুয়েকের মধ্যে চাংগুরতলে জমি ব্যবস্থা করে বাঁশ-বেতের কাঠামো তৈরি করে কলেজ স্থানান্তরিত হয়। জমিদাতা মাধবচন্দ্র দাস জমি ও নগদ ৫০ হাজার টাকা দান করায় কলেজের নামকরণ করা হয় এমসিডি কলেজ। এই কলেজের জন্য প্রায় সাত বিঘা জমি দান করেছেন।
সোনাই ক্লাব গড়ার সূচনালগ্নে তিনি সভাপতি ছিলেন। তিনি একজন এবং সালিশ ব্যক্তিত্ব হিসেবেও সুপরিচিত। তিনি একজন সামাজিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও সুপরিচিত। এলাকার হিন্দু কিংবা মুসলিম সমাজের প্রতিটি বিয়ে কিংবা অন্য সামাজিক অনুষ্ঠানে তজমুল আলি মজুমদার অনুপস্থিত, এটা হতে পারে না। পটল মজুমদার একজন উচ্চশিক্ষিত, অভিজাত পরিবার তথা একটি কলেজের অধ্যক্ষ। কিন্তু পদবি কিংবা আভিজাত্য নিয়ে নেই তাঁর কোনও গরিমা। সবার সঙ্গে সাদা মন নিয়ে কথা বলেন। এলাকার ছোট-বড় সবাই তাঁকে ‘পটল স্যার’ সম্বোধন করে কথা বলেন।
তজমুল আলি মজুমদার ছাত্রজীবন থেকে কংগ্রেস রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। কয়েক বছর তিনি সোনাই ব্লক কংগ্রেস সভাপতিও ছিলেন। ১৯৯১ সালে কংগ্রেস দলের প্রার্থী হয়ে বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতাও করেন কিন্তু পরাজিত হন। ২০১৬ সালে সোনাই আসন থেকে আমিনুল হক লস্কর বিজেপি প্রার্থী হিসেবে বিধায়ক নির্বাচিত হন। এই সময় আমিনুলের কিছু ব্যতিক্রমী কাজকর্মে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর সভা এবং সরকারি অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকতেন। বিজেপি নেতার সভা-সমিতিতে তজমুল আলির উপস্থিতি নিয়ে অনেক বিরূপ সমালোচনাও হতো। কেউ কেউ তাঁকে ‘পটল শুক্লবৈদ্য’ বলে আড়ালে-আবডালে মন্তব্য করতেন। পটল মজুমদার কিন্তু বিজেপির সদস্যপদ নেননি। শুধু আমিনুলকে ভালবেসে তাঁর সঙ্গে থাকতেন। তজমুল আলি মজুমদার সোনাই এলাকায় এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব।