মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে খোলা চিঠিপ্রদীপ দত্ত রায়ের
বরাক তরঙ্গ, ২৭ আগস্ট : মুখ্যমন্ত্রী ড. হিমন্ত বিশ্ব শর্মার উদ্দেশে খোলা চিঠি লিখলেন বরাক ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের মুখ্য আহ্বায়ক প্রদীপ দত্ত রায়। তিনি চিটিতে বাঙালির নানা সমস্যা তুলে ধরেন।
মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মহাশয়,
আপনি বরাক উপত্যকা সফরে এসে এ উপত্যকার মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে আগামী কুড়ি বছর পর বরাক উপত্যকা বাংলাদেশে পরিণত হয়ে যাবে। এটা ৪৫ লক্ষ বরাকবাসী মেনে নিতে পারছে না। বরাক উপত্যকায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, বর্মন, মণিপুরী, চা বাগিচার মানুষ সহ অন্যান্য উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ। এই উপত্যকায় শান্তির পরিবেশ বজায় রয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও বলেছিলেন ‘বরাক শান্তির দ্বীপ’। বাবরি মসজিদ যখন ভাঙা হয়েছিল তখন সারাদেশে দাঙ্গা হয়েছিল কিন্তু বরাক উপত্যকা এর ব্যতিক্রম ছিল। সম্প্রীতি হল বরাক উপত্যকার ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি। তাই এধরনের কথা বলে বরাকের হিন্দুদের মনে শঙ্কা তৈরীর চেষ্টা না করাটাই ভাল। আপনি বদরুদ্দিন আজমলকে ঘুটি বানিয়ে এতদিন যে হিন্দু মুসলমানের খেলাটা খেলেছিলেন সেটা এখন শেষ হয়ে গেছে। কারণ, আজমল এখন ক্ষমতার বাইরে। তাই এখন নতুন পন্থা আপনি অবলম্বন করছেন। এর আগেও বলেছেন, আসামে প্রায় চল্লিশ শতাংশ মানুষ নাকি মুসলমান। এভাবে বাঙালিদের মধ্যে বিশেষ করে হিন্দুদের মধ্যে একটা ভীতির সঞ্চার করা হচ্ছে। এটা একজন মুখ্যমন্ত্রীর মুখে শোভা পায় না। আপনার যদি হিন্দুদের প্রতি এতই ভালোবাসা, এতই প্রীতিভাব থাকে তাহলে আপনি তো অসমিয়া হিন্দু এবং বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তোলার পদক্ষেপ কেন গ্রহণ করছেন না? আজ অবধি এ ধরনের কোন উদ্যোগ নিয়েছেন বলে আমার তো মনে হয় না। আপনি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাঙালিদের কিভাবে দুর্বল করে রাখা যায় সেই চেষ্টা করে আসছেন।
সন্তোষমোহন দেবের পর বরাক উপত্যকার একজন প্রভাবশালী নেতা ছিলেন গৌতম রায়। তার কথা দিসপুরের সচিবালয়ে শুনতো। তাকে সিবিআই ইডির ভয় দেখিয়ে বিজেপি দলে যোগদান করিয়ে এখন ঘরে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিলাদিত্য দেব ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিদের মুখপাত্র হয়ে উঠেছিলেন তাঁকে দ্বিতীয়বার বিধায়ক পদে মনোনয়ন না দিয়ে ঘরে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবার উত্তর করিমগঞ্জের বিধায়ক কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থের পালা। জানিনা তার ভাগ্যে কি আছে। তাঁকে ইডি, সিবিআই, ভিজিলেন্সের ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বিধানসভায় বাংলায় কথা বলতেন, বাঙালিদের স্বার্থ নিয়ে আওয়াজ তুলতেন। এখন কেন তিনি অসমিয়ায় কথা বাধ্য হয়েছেন তা আমি জানি না। তাঁকে বাধ্য করা হয়েছে বিজেপি মুখী হতে এটা আমি মনে করি।
তারপর আসছি অন্য প্রসঙ্গে, অসম সাহিত্য সভাকে তাঁদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বিস্তারের জন্য ৮ কোটি টাকা দিয়েছেন। বড়ো সাহিত্য সভাকে পাঁচ কোটি টাকা, ডিমাসা সাহিত্য সভাকে তিন কোটি টাকা, কিন্তু বরাক উপত্যকা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনকে আপনি একটি টাকাও দেননি। এর থেকে কি বোঝা যায়? বাঙালিদের প্রতি আপনার প্রকৃত দরদ আছে। অটল বিহারী বাজপেয়ির স্বপ্নের প্রকল্প ইস্ট ওয়েস্ট করিডোর বা মহাসড়ক যা সারা ভারতবর্ষে সম্পূর্ণ হয়ে গেছে কিন্তু হারাঙ্গাজাও থেকে বালাছড়া পর্যন্ত মাত্র ৩১ কিলোমিটার সড়ক গত ১০ বছরেও শেষ হচ্ছে না, এর কারণ কি, জবাব দিতে পারবেন আপনি। শিলচর শহরের রাস্তাঘাটের যে বেহাল দশা তা আপনি এই সফরে প্রত্যক্ষ করতে পারতেন, কিন্তু আপনার সফরের আগে রাতারাতি জোড়া তালি দিয়ে গর্তগুলি ভরাট করে চিত্রটা পাল্টানোর চেষ্টা করা হয়েছে। স্থানীয় মানুষ বারবার এর প্রতিবাদ করেছেন বলেছেন যে এখন আপনারা এটা সংস্কার করবেন না মুখ্যমন্ত্রীকে দেখে যেতে দিন। স্থানীয় জনতা রাস্তায় নেমে পাড়ায় পাড়ায় এ নিয়ে প্রতিবাদও করেছেন। তাঁরা স্পষ্টই বলেছেন, আগে যখন বারবার এই রাস্তা সংস্কারের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিল তখন তো বিভাগীয় তরফে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি এখন কেন রাতারাতি এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে? তড়িঘড়ি করে সড়ক সংস্কারের যে অর্থ ব্যয় করা হলো এই অর্থ কার , এটাতো জনগণের অর্থ।
মুখ্যমন্ত্রী হয়ে আপনি মুসলমানদের দোষারোপ করছেন। কথায় কথায় কেবলমাত্র মুসলমানদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ, মুসলমানরা আসামের খিলঞ্জিয়া। ব্রিটিশরা যখন বরাক উপত্যকায় ১২৫টি চা বাগান স্থাপন করল তখন চা শ্রমিকদের খাদ্য জোগানোর ব্যবস্থা করার জন্যই তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে মুসলমানদের চাষাবাদ করার জন্য এখানে এনে সংস্থাপন দেয়। এই জনগোষ্ঠীর মানুষ চাষাবাদ করছে বলেই বরাক উপত্যকা নয় গোটা আসামের মানুষ কৃষি পণ্য পাচ্ছে। এর কোন বিকল্প নেই। তাই কেবল মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব নেওয়া ঠিক নয়। একটা রাষ্ট্র, একটা দেশ, একটা সরকারকে চলতে হলে সমগ্র দেশের বিভিন্ন জাতি, জনজাতি জনগোষ্ঠীকে নিয়ে চলতে হয়। জনগোষ্ঠীগত ভারসাম্য বজায় রাখা দরকার। কাজেই হিন্দু-মুসলিম সবাইকে নিয়ে চলতে হবে। আর এটাই হচ্ছে বরাক উপত্যকার ধর্ম। কাজেই বরাকবাসীকে এ ধরনের কথা না বলাটাই হবে শ্রেয়।
মুখ্যমন্ত্রী আপনার যদি হিন্দুদের প্রতি এতই দরদ তাহলে এ উপত্যকায় ৫ লক্ষ রেজিস্টার্ড বেকার রয়েছে, প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২ হাজার যুবক-যুবতী মাস্টার ডিগ্রী নিয়ে বেরোচ্ছে। কিন্তু কর্মসংস্থান না থাকায় শিক্ষিত বেকাররা ই-রিকশা বা টুকটুকি চালাতে বাধ্য হচ্ছে। কোনও চাকরি নেই। আপনি রাজ্যে আশি হাজার চাকরি দিলেন এর মধ্যে বরাক উপত্যকার মাত্র ১১২জন। ৩০ শতাংশ জনসংখ্যার মধ্যে ১১২ জনের চাকরি সেটাকে যুক্তিসঙ্গত? আপনি বাঙালিদের জন্য কি করেছেন? আপনি করিমগঞ্জের মিশনরঞ্জন দাসকে রাজ্যসভায় টিকিট দিয়েছেন , তাকে আমরা স্বাগত জানাই। কারণ ২০০৯ সাল থেকে এই উপত্যকায় কোনো রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন না। তবে তাকে দিয়ে বরাক উপত্যকার মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা মিটবে কিনা আমি জানি না, কারণ তাকে মাত্র ৯ মাস ১১ দিনের জন্য রাজ্যসভার সাংসদ নির্বাচিত করা হচ্ছে। তার কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আবার যদি তাঁকে প্রার্থী করা হয় তখন বুঝব যে আপনি সত্যিকারের বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব চাচ্ছেন। আপনি রাজদীপ রায়কে মনোনয়ন দিলেন না । আমরা তো জানি তার নাম রাজ্যসভার প্রত্যাশীর তালিকায় ছিল। এক নম্বরে ছিল, দিল্লি তার নাম অনুমোদন দিয়েছিল। আপনি দিল্লি গিয়ে তার নাম কেটে দিলেন। কারণ, রাজদীপ রায় পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ। আগে লোকসভার সাংসদ ছিলেন। তাকে রাজ্যসভায় পাঠালে তিনি হয়তো মন্ত্রী হতে পারতেন। সে রাস্তাটাও আপনি বন্ধ করে দিলেন। এভাবেই প্রতিপদে আপনি বাঙালিদের কোনঠাসা করে রাখার চেষ্টা করে চলেছেন। আপনি যদি হিন্দুদের মঙ্গল চান তাহলে বাঙালি-অসমিয়া ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলার উদ্যোগ নিন। আপনার কাজে আর মুখের কথায় বিরাট ফারাক। এই চিঠির মাধ্যমে আপনাকে অনুরোধ জানাচ্ছি বাস্তবে বিষয়টি উপলব্ধি করুন। বরাকের উন্নয়ন করুন তাহলে বরাকবাসী আপনাকে মাথায় তুলে রাখবে।
প্রথমত বলছি, ১৯৬১ সালে মাতৃভাষার অধিকার আন্দোলনে যে ১১ জন শহিদ হয়েছিলেন তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনকে ভাষা শহিদ স্টেশন নামকরণের দাবি উঠেছিল। কেন্দ্রীয় সরকার এ দাবির মান্যতা দিয়েছে। রেলমন্ত্রক এ দাবিটি অনুমোদন দিয়েছে। স্টেশনের নামকরণ কি ধরনের করা যায় এ নিয়ে রেল মন্ত্রক রাজ্য সরকারকে চিঠি দিয়েছিল কিন্তু রাজ্য সরকার এ চিঠির কোন জবাবই দেয়নি। এটা খুবই পরিতাপের বিষয়। বাঙালি হিন্দু মুসলমান মিলে অসমে বসবাস করেন ৩০ শতাংশ মানুষ। কিন্তু এই বাংলা ভাষাকে রাজ্যের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কোনো প্রচেষ্টা আপনার সরকার করেনি। ৩০ লক্ষ জনগোষ্ঠীর ভাষা বড়োকে আপনি সহযোগী রাজ্য ভাষার মর্যাদা দিয়েছেন। ভালো কথা, এতে আপত্তি করছি না, তাছাড়া আপনি মনিপুরী ভাষাকে রাজ্যের কয়েকটি জেলায় সহযোগী সরকারি ভাষার মর্যাদা দিয়েছেন, আমরা এ সিদ্ধান্তকেও স্বাগত জানাচ্ছি। কিন্তু বাংলা ভাষাকে সহযোগী রাজ্য ভাষার মর্যাদা দিতে আপনার এত অনীহা কেন? বাঙালিদের অবদান আসাম কি কোনদিন ভুলতে পারবে? শিলং যখন অসমের রাজধানী ছিল তখন সেখানকার সচিবালয়ে ৭০ শতাংশ আধিকারিক, কর্মচারী ছিলেন বাঙালি। আজ রাজধানী দিসপুরে সচিবালয়ে ৫ শতাংশ বাঙালিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। হিতেশ্বর শইকিয়া যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন আসামের অর্থ সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব সহ পুলিশ বিভাগের উচু পদে অনেক বাঙালি ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী আপনি কি বলতে পারবেন বর্তমানে অসমে কয়জন বাঙালি এসপি রয়েছে, আপনি কি দিতে পারবেন তাদের নাম? কতজন বাঙালি এসিএস অফিসার আছে আপনি কি বলতে পারবেন তাদের নাম, পারবেন না। আসামে পুলিশ বিভাগে বাঙালির সংখ্যা হচ্ছে মাত্র দুই শতাংশ। পুলিশ বিভাগ থেকে বাঙালিকে একপ্রকার নির্বাসন দেওয়া হয়েছে। বাঙালিদের উন্নতি না হলে রাজ্য কীভাবে উন্নয়নের শিখর ছুঁতে পারবে।
এইযে শিলচর শহরের রাস্তাঘাট এর মধ্যে এত বেশি যানবাহন চলাচল করে তাতে যানজট লেগেই থাকে। এর জন্য উড়ালপুল তৈরির দাবি দীর্ঘ দিনের। যাইহোক এবার শিলচর শহরের দুটি উড়ালপুল তৈরির জন্য ১২০০ কোটি টাকা মঞ্জুর করার কথা ঘোষণা করেছেন আপনি। এর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এই উড়ালপুল তৈরি করতে গিয়ে শহরের নাগরিকদের মতামত নেওয়ার কথা কেন বলছেন আপনি। শহরের নাগরিকরা একমত হবেন এমন সম্ভাবনা কম। এর কোন প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করছি না। গুয়াহাটিতে যেমন প্রশাসনিক উদ্যোগে উড়ালপুল তৈরি হয় এখানেও তেমনভাবেই প্রশাসনের উদ্যোগে তা করতে হবে। সরকার উদ্যোগ নিলে কেউ তাকে বাধা দেবে বলে আমার মনে হয় না। একটা জিনিস মনে রাখতে হবে ডলু চা বাগানে গ্রিনফিল্ড এয়ারপোর্ট তৈরি করার জন্য যখন সজীব চা গাছগুলিকে তুলে ফেলা হয়েছিল তখন শ্রমিক বা অন্যান্য মহলের কোন আপত্তির কথা তখন শোনা হয়নি। কাজেই উড়ালপুলের ক্ষেত্রেও কারো কোনো আপত্তির কথা শোনারও প্রয়োজন থাকবে না। কারণ উড়ালপুল হলে যানজট সমস্যা থেকে শহরের নাগরিকরাই রেহাই পাবেন এটাকে সবাই স্বাগত জানাবেন। রাঙ্গিরখাল পুনরুদ্ধারের জন্য ঘরবাড়ি ভাঙ্গা হচ্ছে, কই তাতে তো কোন অসুবিধা হচ্ছে না। শিলচর শহরের অন্যান্য সড়কের পাশেও নর্দমা নির্মাণ করতে গিয়ে বেদখল করা ঘরবাড়ি ভাঙতে হয়েছে। এতে তো কোনো অসুবিধা হয়নি। তাহলে উড়ালপুলের ক্ষেত্রেও কোনও অসুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আপনার কাছে আমার অনুরোধ উন্নয়নের স্বার্থে কাজ করে যান তাহলে মানুষ আপনাদের পাশে থাকবে। এর জন্য উদার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসুন। মানুষের মধ্যে শঙ্কার পরিবেশ তৈরি না করে যোগ্য নেতৃত্বের গুনে রাজ্যকে শীর্ষস্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন তা হবে রাজ্যের সকল জনগোষ্ঠীর জন্য মঙ্গলের।