মোহাম্মদ জনি, শ্রীভূমি।
বরাক তরঙ্গ, ২৬ ডিসেম্বর : বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বাঙালি যুবক দীপুচন্দ্র দাসকে নৃশংসভাবে জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার পর থেকেই প্রতিবাদের সুর চড়া হয়ে উঠেছে বরাক উপত্যকায়। ওই ঘটনার বিরুদ্ধে প্রথম দিন থেকেই ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে আসছে করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেস। কিন্তু সেই প্রতিবাদের মধ্যেই আবারও বাঙালিদের উপর নেমে আসে নতুন করে বর্বরতা ও সহিংসতার কালো অধ্যায়। সম্প্রতি আসামের কার্বি আলং জেলায় দুই নিরীহ বাঙালি যুবক দীপক দে ও সুরোজ দে-কে প্রকাশ্য রাস্তায় বেদড়ক মারধর করে, পরে জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে গোটা রাজ্য জুড়ে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। শুধু হত্যাকাণ্ডই নয়, কার্বি আলংয়ে বসবাসকারী বাঙালিদের উপর পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ নামিয়ে আনার অভিযোগ উঠেছে। একের পর এক বাঙালি পরিবারের ঘরবাড়ি ভেঙে চুরমার করা হয়, লুটপাট চালানো হয় এবং বহু বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। বহু পরিবার প্রাণভয়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে বলে জানা গেছে।এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির পরেও আসাম সরকার ও কেন্দ্র সরকারের ভূমিকা নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছে করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেস।
দলের অভিযোগ, এত বড় মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরেও সরকার কার্যত নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। সরকারের ঘনিষ্ঠ ও সমর্থক সংগঠনগুলোর নীরবতাও প্রশ্নের মুখে পড়েছে।এই সমস্ত ঘটনার প্রতিবাদে বুধবার সন্ধ্যা ছয়টায় করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেসের উদ্যোগে এক বিশাল প্রতিবাদী মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলটি করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেস কার্যালয় ইন্দিরা ভবন থেকে শুরু হয়ে শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পথ পরিক্রমা করে এওসি পয়েন্ট (পেট্রোল পাম্প) এসে সমাপ্ত হয়।মিছিলে প্রায় দুই শতাধিক কংগ্রেস কর্মী, সমর্থক ও সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করেন।মিছিল চলাকালীন প্রতিবাদকারীদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় একের পর এক স্লোগান কেন্দ্র সরকার মুর্দাবাদ রাজ্য সরকার মুর্দাবাদ বাঙালি নিধন বন্ধ কর “বাংলাদেশ, আসাম, উড়িষ্যা সহ সর্বত্র বাঙালি হত্যার বিচার চাই প্রতিবাদে শামিল হন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সাধারণ নাগরিকরাও, যা এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক গণ্ডির বাইরে এনে এক সর্বজনীন মানবিক প্রতিবাদে রূপ দেয়। মিছিল শেষে করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেস সভাপতি তাপস পুরকায়স্থ এক সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে দিপু চন্দ্র দাসকে জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যা, আর কার্বি আংলঙে দীপক দে ও সুরোজ দে-কে নির্মমভাবে হত্যা এই সবকিছুই প্রমাণ করে বাঙালিদের উপর পরিকল্পিত আক্রমণ চলছে। অথচ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ ও নির্বিকার। এই পরিস্থিতির জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সরাসরি দায়ী।
তিনি আরও বলেন, অবিলম্বে দোষীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে কংগ্রেস বৃহত্তর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবে। বাঙালিদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব বলেও তিনি মন্তব্য করেন। এদিকে, করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেসের মিডিয়া ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান শাহাদত আহমদ চৌধুরী বলেন,আজ আমরা এমন এক ভয়াবহ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে শুধু মানুষ হত্যা নয় হত্যা করা হচ্ছে মানবতা, সংবিধান ও সভ্যতাকে। বাংলাদেশে দীপুচন্দ্র দাসকে জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যা এবং আসামের কার্বি আংলঙের দীপক দে ও সুরোজ দে-কে নির্মমভাবে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়, এটি পরিকল্পিতভাবে বাঙালিদের ভয় দেখানো ও নিশ্চিহ্ন করার এক ভয়ংকর চক্রান্ত।তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল, এত বড় নৃশংসতার পরেও কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। আসাম সরকার যেমন ব্যর্থ, তেমনই কেন্দ্র সরকারও সম্পূর্ণ উদাসীন। এই নীরবতা অপরাধীদের আরও সাহস জোগাচ্ছে। যদি সরকার সত্যিই সংবিধান ও মানবাধিকারের প্রতি দায়বদ্ধ হত, তাহলে আজ রাস্তায় নেমে আমাদের প্রতিবাদ করতে হত না।
শাহাদত আহমদ চৌধুরী বলেন, কার্বি আলংয়ে যেভাবে বাঙালিদের ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, তা ১৯৪৭ কিংবা ১৯৭১-এর বিভীষিকার কথা মনে করিয়ে দেয়। আজ নিজের দেশেই বাঙালিরা অনিরাপদ এ এক লজ্জাজনক বাস্তবতা। আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, বাঙালির রক্তের উপর দাঁড়িয়ে কোনও সরকার বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। তিনি জোর দিয়ে বলেন করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেস রাজনীতি করে ক্ষমতার জন্য নয়, আমরা রাজনীতি করি মানুষের অধিকারের জন্য। আজকের এই প্রতিবাদী মিছিল কোনও দলের কর্মসূচি নয়, এটি এক মানবিক আর্তনাদ। আমরা চাই অবিলম্বে এই সমস্ত হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ বিচার, দোষীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।শেষে তিনি বলেন,যদি আজ আমরা চুপ করে থাকি, তাহলে আগামী দিনে আরও বহু দীপক, সুরোজ কিংবা দিপু চন্দ্র দাসের প্রাণ যাবে। তাই আমরা সবাইকে আহ্বান জানাই দল, ধর্ম, ভাষার ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালির উপর চলা এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হোন। করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেস এই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকবে। এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেসের একাধিক নেতা-কর্মী ও সংগঠনের পদাধিকারীরা।
অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন বিশ্বজিৎ ঘোষ, সন্দীপ নন্দী, পঙ্কজ নাগ, অনুরাগ দত্ত, মমতাজ বেগম, হাসিনা রহমান, গৌরাঙ্গ দে, নৃপেন্দ্র চন্দ্র, প্রদীপ কুরি, মানিক দাস, শুভজিৎ চক্রবর্তী ও সোনু দাস প্রমুখ। শেষে করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, যতদিন না বাঙালিদের উপর সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও হিংসার সঠিক তদন্ত হয় এবং অপরাধীরা শাস্তির আওতায় আসে, ততদিন এই প্রতিবাদ আন্দোলন চলবে। মানবতা, ন্যায়বিচার ও সংবিধান রক্ষার লড়াইয়ে কংগ্রেস পিছিয়ে থাকবে না।


