সিইউইটি পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে স্মারকপত্র প্রদান
বরাক তরঙ্গ, ২৭ মার্চ : দরিদ্র-নিম্নবিত্ত পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষা অর্জনের দ্বার রুদ্ধের উদ্দেশ্যে আয়োজিত সিইউইটি পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে বৃহস্পতিবার এআইডিএসও’র কাছাড়, শ্রীভূমি ও হাইলাকান্দি জেলা কমিটির পক্ষ থেকে একটি স্মারকপত্র আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নিকট প্রদান করা হয়। সংগঠনের তিন জেলার একটি প্রতিনিধি দল আজ আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে উপাচার্যের উদ্দেশ্যে প্রদান করা স্মারকপত্র ভারপ্রাপ্ত রেজিষ্টার জয়ন্ত ভট্টাচার্যের হাতে তুলে দেয়। স্মারকপত্রে উল্লেখ করা হয় যে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজগুলোতে স্নাতক স্তরে ভর্তির জন্য ‘এনটিএ’ কর্তৃক আয়োজিত সর্বভারতীয় স্তরের ‘সিইউইটি’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার নির্দেশ জারি করা হয়েছে অথচ ছাত্র ছাত্রীরা এই পরীক্ষায় বসার আবেদন করতে গিয়ে লক্ষ্য করেছেন যে প্রার্থীদের পরীক্ষা কেন্দ্র গতবছরের মতো শুধুমাত্র কাছাড় জেলাতেই রয়েছে। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কাছাড় জেলা ছাড়াও করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, ডিমা হাসাও, কার্বি আংলং জেলার কলেজগুলোও অন্তর্ভুক্ত। এই সিদ্ধান্তের ফলে সেইসব জেলার ছাত্র -ছাত্রীরা আবারো নিজের জেলায় পরীক্ষা দেওয়ার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। এছাড়াও এই পরীক্ষা ইংরেজি, অসমীয়া, বড়ো মাধ্যমে গ্রহণ করা হবে অথচ বরাক উপত্যকার তিন জেলায় অসংখ্য স্কুলে ছাত্র ছাত্রীরা উচ্চ মাধ্যমিকে বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে। ফলে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যারা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা উত্তীর্ণ হবে তাদের পক্ষে সিইউইটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া প্রায় অসম্ভব। গতবছর যারা সিইউইটি পরীক্ষায় বাংলা বিষয়ের পরীক্ষা দিতে আবেদন করেছিল তাদেরকে বরাক উপত্যকার বাইরে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ও পার্শ্ববর্তী রাজ্যের বিভিন্ন স্থানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। বাংলা বিষয় নিয়ে যাতে ভবিষ্যতে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা না করে সেই উদ্দেশ্যে তা করা হয়েছিল।
সংগঠনের প্রতিনিধিরা বলেন, পরীক্ষায় আবেদনকারীদের কাছ থেকে অহেতুক অতিরিক্ত হারে ফিজ আদায় করা হয়েছে যা আর্থিক দিক থেকে দুর্বল পরিবারের ছাত্র ছাত্রীদের পক্ষে বহন করা ভীষণ কষ্টকর। যেসব ছাত্র ছাত্রীদের পরীক্ষায় বসার জন্য শিলচরে বা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ও পাশ্ববর্তী বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে পরীক্ষায় বসতে হয় তাদের থাকা, খাওয়া বাবদ প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয় যার জন্য গত বছর গরীব ঘরের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়েছিল।

তাঁরা বলেন, এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে গেলে ছাত্র ছাত্রীদের ভবিষ্যতে কোচিং সেন্টারের উপর ভরসা করতে হবে। ফলে দরিদ্র পরিবারের ছাত্র ছাত্রীদের পক্ষে তা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। সাধারণ কলেজের সাধারণ পাঠ্যক্রমে ভর্তির নিয়ন্ত্রণ কোচিং মাফিয়াদের হাতে চলে যাবে। এই ব্যবস্থায় দেশের বিশাল সংখ্যক দরিদ্র পরিবারের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা কলেজগুলোতে ভর্তির সুযোগ পাবে না এবং সরকারি কলেজগুলোতে ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা হ্রাসের অজুহাতে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। আশ্চর্যের বিষয় যে এই পরীক্ষা আয়োজন এবং এর সেন্টার নির্ধারণের ক্ষেত্রে আসাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা রাজ্য সরকারের কোনো ধরনের মতামত গ্রহণ করা হয় না। এই প্রক্রিয়ায় সংবিধান প্রদত্ত শিক্ষার যুগ্ম অধিকার ও দায়িত্ব রাজ্য সরকারের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীকারের উপরও হস্তক্ষেপ করা হয়েছে।
সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয় যে জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০২০ শিক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্রীয়করণ ও ব্যানিজ্যিকীকরণের যে সব পদক্ষেপ নিয়েছে তার অন্যতম হচ্ছে সিইউইটি পরীক্ষা আয়োজন। ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় দেশে সিলেবাস, কারিকুলাম ইত্যাদি তৈরির ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যে ভূমিকা ভারতের সংবিধানে রয়েছে তাকে নস্যাৎ করে দিয়ে গোটা দেশের শিক্ষা পদ্ধতিকে একই ছাতার নীচে নিয়ে আসা হচ্ছে যাতে একদিকে শিক্ষার বেসরকারিকরণ ও ব্যক্তিগতকরণ ঘটানো সহজ হয় এবং অন্যদিকে মধ্যযুগীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন অবৈজ্ঞানিক ধ্যান, ধারণা সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করে দেশে বিভাজনের রাজনীতিকে আরও শক্তিশালী করা হয়। একই সঙ্গে দেশি বিদেশি মুনাফাখোর কর্পোরেটদের লুন্ঠনের মৃগয়া ক্ষেত্র হিসেবে যাতে দেশের শিক্ষা খণ্ডকে তুলে দেওয়া যায়।
বরাক উপত্যকা সহ দক্ষিণ অসমের ছাত্রছাত্রীরা যে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, কার্যত উন্নত পরিকাঠামোহীন ও পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব থাকা অবস্থায়ও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে সেখানে এধরনের সর্বভারতীয় স্তরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে ভর্তির সুযোগ প্রদান কতটুকু যুক্তিসঙ্গত।

সংগঠনের প্রতিনিধিরা আসাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট দাবি জানান যে আসাম হায়ার সেকেণ্ডারী কাউন্সিল বা তার সমতূল্য সরকার নিয়ন্ত্রিত বোর্ড থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া ছাত্র ছাত্রীদের মার্কের ভিত্তিতেই তাদের অনুমদিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ দিতে হবে। অন্যথায় বিশাল সংখ্যক ছাত্র ছাত্রীরা কলেজে ভর্তি হওয়া থেকে বঞ্চিত হবে।

এআইডিএসও’র প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য কাছাড় জেলা কমিটির সভাপতি স্বাগতা ভট্টাচার্য বলেন, গতবছর সিইউইটি পরীক্ষা আয়োজনের বিরুদ্ধে এবং এই পরীক্ষার ফলাফলের উপর ভিত্তি না করে ছাত্র ছাত্রীদের হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে প্রচলিত পদ্ধতিতে ভর্তির সুযোগ প্রদানের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল এর ফলে আসাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও আসাম সরকার সিইউইটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা থেকে বঞ্চিত, বিরত ও অনুত্তীর্ণ ছাত্র ছাত্রীদের কলেজগুলোতে ভর্তির সুযোগ প্রদান করেছিল। এবারও সিইউইটি পরীক্ষা বাতিল এবং হায়ার সেকেন্ডরি পরীক্ষায় প্রাপ্ত মার্কের ভিত্তিতে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তির সুযোগ প্রদানের দাবিতে তীব্র ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। সংগঠনের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে দেশের শিক্ষামন্ত্রী, এনটিএ’ এর চেয়ারম্যান এর কাছে স্মারকপত্র পাঠানো হয়েছে।
এ দিন আসাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেও স্মারকপত্র প্রদান করা হয়। স্মারকপত্রে স্বাক্ষর করেন কাছাড় জেলা সভাপতি স্বাগতা ভট্টাচার্য, করিমগঞ্জ জেলার পক্ষে জয়দীপ দাস, হাইলাকান্দি জেলার পক্ষে কাঞ্চনী সরকার এবং স্মারকপত্র প্রদান কালে সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাবলী দাস, তুতন দাস, শিবা দাস সহ অন্যান্যরা।