অসমে বসবাসকারী প্রত্যেক বাঙালিই ভূমিপুত্র : বরাকবঙ্গ
বাঙালিকে উপেক্ষিত করে ভূমিপুত্রের সংজ্ঞা হলে বসে থাকবে না সম্মেলন : গৌতম দত্ত
বরাক তরঙ্গ, ২৬ নভেম্বর : প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অসমে বসবাস করে এ রাজ্যের সার্বিক বিকাশ তৎপরতায় অন্যতম অংশীদার দুই উপত্যকার বাঙালি জনগোষ্ঠীও যে ঐতিহাসিকভাবেই এখানকার ভূমিপুত্র সে দাবি আবারও উত্থাপন করল বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন। মঙ্গলবার শিলচর বঙ্গভবনে সম্মেলনের তরফে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলা হয়েছে, আসাম চুক্তির ৬ নং ধারা রূপায়ণের জন্য বিপ্লব শর্মা কমিটির সুপারিশকে সামনে রেখে এ রাজ্যের বাঙালি জনগোষ্ঠীকে নিযুক্তি, বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও ভাষা সংস্কৃতি রক্ষার ক্ষেত্রে উপেক্ষা ও বঞ্চনার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তাতে তারা উদ্বিগ্ন।
সম্মেলনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গৌতম প্রসাদ দত্ত এ বিষয়টি উল্লেখ করে জানান, বিভিন্ন সময়ে তাঁরা এ সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। গত ২১ নভেম্বর দিসপুর জনতা ভবনে শিক্ষামন্ত্রী রণোজ পেণ্ড আহুত বিভিন্ন ভাষিক গোষ্ঠীর বৈঠকেও আমন্ত্রিত হয়ে সম্মেলনের তরফে এই উদ্বেগের কথা তাঁর নজরে এনে পক্ষপাতিত্বহীন পদক্ষেপের আর্জি জানানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিপ্লব শর্মা কমিটি রাজ্যবাসীর অভিমত সংগ্রহের জন্য ২০১৯ সালে যে আহ্বান রেখেছিলেন তাতে সাড়া দিয়ে সম্মেলনের তরফে লিখিত অভিমত পাঠিয়ে ঐতিহাসিক সব তথ্য তুলে ধরা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, বাঙালিরাও এই রাজ্যের ভূমিপুত্র, তাদের যেন কোনওভাবেই সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা না হয়। পরবর্তী সময়ে শর্মা কমিটি যখন শিলচরে শুনানি গ্রহণ করতে আসে তখনও তাতে আমন্ত্রিত হয়ে একই অভিমত জানানো হয়। সে সময় অভয় দেওয়া হয়েছিল যে উদ্বেগের কোনও কারণ নেই। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ঘটনাক্রমে দেখা যাচ্ছে, খুব সুকৌশলে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করার প্রবণতা ক্রিয়াশীল। কোনও কোনও মহল থেকে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশি বা বহিরাগত বলে নানাভাবে হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এটা ঐতিহাসিক সত্য যে ১৮৭৪ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে কাছাড়, গোয়ালপাড়া ও সিলেট জেলাকে অসমের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করার সময় থেকে তারা এ রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা। তাই আজ তাদের উত্তর প্রজন্ম যারা এ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আলো হওয়া রৌদ্রে বেড়ে ওঠে সবার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে কল্যাণ যজ্ঞে অংশীদার তাদের পরিচয় নিয়ে সন্দেহের আবহ তৈরি করা রাজ্যের পক্ষে মঙ্গলকর হবে না।
গত ২১ নভেম্বর বরাকবঙ্গের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পক্ষে শিক্ষামন্ত্রী আহুত বৈঠকে উপস্থিত থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সব্যসাচী রুদ্রগুপ্ত বরাকবঙ্গের অভিমতের কথা জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর হাতে লিখিত স্মারকপত্র তুলে দেন। ওই স্মারকপত্রে বলা হয়েছে, বিগত ৪৮ বছর ধরে সম্মেলন বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা, বিকাশ, পাঠদান এবং ১৯৬১ সালের আসাম সরকারি ভাষা আইন (সংশোধনী) অনুসারে বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার অধিকার সংরক্ষণে নিরলস ভাবে কাজ করার পাশাপাশি প্রতিবেশী ভাষিক গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রেখে তাদের ভাষা শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চায় উৎসাহ প্রদান করে আসছে। গত ৮ নভেম্বর শিক্ষামন্ত্রী রণোজ পেণ্ডর লিখিত আহ্বানে সাড়া দিয়ে সম্মেলন শিলচরের কেন্দ্রীয়ভাবে’ ভাষা গৌরব সপ্তাহ’ উদযাপন করেছে। ওই অনুষ্ঠানে সম্মেলনের প্রতিনিধি ছাড়াও অসম সাহিত্য সভা, মণিপুরি সাহিত্য পরিষদ, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সাহিত্য পরিষদ, ডিমাসা সাহিত্য সভা ও হিন্দি সাহিত্য সমিতির প্রতিনিধিরা উপস্থিত থেকে মতবিনিময় করেছেন। ওই অনুষ্ঠান থেকে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, সবার সম্মিলিত প্রয়াস ছাড়া এই রাজ্যের পরিপূর্ণ উন্নতি সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে রাজ্যের বিভিন্ন স্তরের বিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয়গুলোতে বাংলা ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে তার আশু সমাধানে শূন্য পদগুলোতে বাংলা ভাষা শিক্ষক নিযুক্তির দাবি রাখা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রী এই দাবির উত্তরে এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন।
তিনি অভয় দিয়ে বলেছেন, সার্বিকভাবে কোনও জনগোষ্ঠীর আবেগ আহত হয় সরকারের তরফে এমন কাজ করা হবে না। এদিনের সাংবাদিক সম্মেলনে কাছাড় জেলা সমিতির সভাপতি সঞ্জীব দেব লস্কর, এ রাজ্যে বাঙালির বসবাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, বাঙালি জনগোষ্ঠী যেখানে সদর্থক মনোভাব নিয়ে এ রাজ্যে কাজ করছেন সেখানে তাদের সাংবিধানিক এবং অন্যান্য সরকারি আইন অনুসারে প্রদত্ত অধিকার করা উচিত হবে না। এদিন অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের সম্পাদক উত্তমকুমার সাহা, মিলন উদ্দিন লস্কর, আশিস চৌধুরী, সুবীর রায় চৌধুরী, মানিক চক্রবর্তী, পরিতোষ চন্দ্র দত্ত, দীপক সেনগুপ্ত, অনিল পাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।