শৈশবের মহালয়া ও দুর্গাপূজা
।। বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য, শিলচর।।
বরাক তরঙ্গ, ১ অক্টোবর : রাত পোহালেই মহালয়া। দীর্ঘ বারোমাসের প্রতীক্ষার পর বাঙালির উৎসবের ডঙ্কা বেজে উঠবে সেদিন। পৌরাণিক কাহিনী মতে, মহালয়া হলো পিতৃপক্ষ ও দেবীপক্ষের সন্ধিক্ষণ। মহালয়ায় ঢাকে কাঠি পড়া মাত্রেই শারদীয়া দুর্গোৎসবের সূচনা হয়। কথিত আছে, মহালয়ার পূণ্য লগ্নে দেবী দশভূজা দিনকয়েকের জন্য নিজের সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে কৈলাশ থেকে গিরিনগরীতে আসেন। নিজের মেয়েকে দুচোখ ভরে দেখতে অধীর আগ্রহে দিনগুনতে থাকেন গিরিজায়া মেনকা। তাঁকে স্বাগত জানাতে হৈচৈ শুরু হয় গিরিপুরীতে। দিকে-দিকে বেজে ওঠে শঙ্খনাদ, ঢাক, ঘণ্টা, কাঁসর। ঘরের মেয়েকে বরণ করতে শুরু হয় তোরজোড়। ঋতুরানী শরতের ছোঁয়ায় প্রকৃতিও যেনো তাঁর আগমনে রূপবদল করে।
নীল আকাশে পেঁজা তুলা মেঘ, উঠোনজুড়ে ভোরের শিশির ভেজা শিউলি ফুলের নক্সা দেখলেই এক নিমিষেই মন থেকে সব দুঃখই ভ্যানিস হয়ে যায়। ছোটবেলা আশ্বিনমাসের এই শারদীয়া উৎসবকে ঘিরেই ছিল আমাদের যতো জল্পনা-কল্পনা। শ্রাবণী সংক্রান্তির শেষে অর্থাৎ মনসা পুজার পর থেকেই শুরু হতো কাউন্টডাউন। বড়দের কাছ থেকে পুজোর জন্য নতুন জামা কাপড়ের আবদার। অবশ্য, এর সঙ্গে সংযোজন ছিল ক্যাপ বন্দুক ও বেলুনের আবদারও। হরেক পুজোর প্ল্যানিং। সেইসময়ে আমাদের কাছে পুজোর প্ল্যানিং মানেই ছিল কার ক’টা জামাকাপড় হয়েছে তা কড়ায় গণ্ডায় হিসেব রাখা। আর ছিল সকাল-দুপুর-রাতে চুটিয়ে ঠাকুর দেখা। বিশেষ করে রাতের দিকে ঠাকুর দেখে আসার সময় চাট-চাউমিন খাওয়াটাও ছিল বাধ্যতামূলক।
আমাদের যৌথ পরিবার। জেঠু, বাবা, কাকুকে দেখতাম মহালয়ার দিনকয়েক আগেই পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পন করতে। আর মহালয়ার ঠিক আগের রাতে খাওয়া দাওয়ার পর সবাইকে মা জানিয়ে রাখতেন ভোর চারটার আগেই উঠতে হবে। তবে মায়ের সেই আদেশ, আমরা ছোটোদের জন্য প্রযোজ্য ছিলনা। ছিল শুধু বাড়ির বড়দের জন্য। সব প্রথমে যে কাজ, তা হলো ফুল ভ্যলিউমে রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গুরুগম্ভীর সুরে-স্পষ্ট উচ্চারণে চণ্ডীপাঠ শোনা। সেই ট্রেডিশন আজও অব্যাহত। আধখোলা চোখে আমরাও সেই সুর শুনতাম। আর মনে তখন খুশির জোয়ার বইত। অন্ততঃ সাত-আটদিন পড়াশোনা, টিউশন, হোমওয়ার্কে শাটার থাকবে। পড়াশোনা না করলে কেউ কিচ্ছুটি বলবেনা। আবার মহালয়া নিয়েও এক কিউরেসিটি ছিল। ওইদিন পাড়ার বহু মানুষকে অন্ধকার থাকা অবস্থায় বেরিয়ে যেতে দেখতাম। জানতে পারলাম মহালয়ার দিন না কী দেবী দুর্গা দর্শন দেন। পাড়ার বড়-ছোট সবাই তা দেখার জন্য সদরঘাটের সেতুর উপর ভীড় জমান। এখনও মহালয়ার দিন এই দৃশ্য দেখতে দলে-দলে ভক্তরা পাড়ি দেন। আদৌ দেবী সেদিন দর্শন দেন কী না সেই রহস্যের উদ্ঘাটন আজও করতে পারিনি।
পুজার প্রায় কুড়ি-পঁচিশ দিন আগে বাবা রবিবার দেখে ভাই-বোনদের কাপড় কিনে দিতে দোকানে নিয়ে যেতেন। এখানে একটা কথা বলতেই হয়, যখন পুজার ড্রেস কিনতে যাওয়া হতো তখন মনে একটা অন্য অনুভূতি হতো। আর নিজ-নিজ কাপড়টা কেনা হয়ে গেলেই শুরু হয়ে যেতো পায়ে ব্যাথা সহ যতো অস্থিরতা। আসলে যে নতুন জামাকাপড়গুলো কেনা হয়েছে, সেগুলো ঘরে এসে ট্রায়াল না দেওয়া পর্যন্ত স্বস্তি মেলবেনা। ভাই-বোনেরা সেই বিষয়টা বুঝতে না পারলেও বাবা ঠিক বুঝে চুপ থাকতেন।
স্কুল থেকে ফেরার পথে রাস্তায় প্যান্ডেলগুলো দেখার এক অদ্ভূত ভালোলাগা ছিল। অনেক পুজাকমিটি আগেই কাঁচা প্রতিমা নিজেদের প্যান্ডেলে নিয়ে আসতো। এরপর বড় তেরপাল টাঙিয়ে তুলির শেষটানের কাজ করতো। আমরা স্কুল শেষে সেই প্যান্ডেলগুলোতে উঁকি দিতাম, বাঁধানো বাঁশগুলোর মধ্যে ডিগবাজি দিতাম। এগুলো দেখে পুজা কমিটির জেঠু-কাকুরা চোখ রাঙালেও আমরা নির্ভীক ছিলাম। ছিলাম নিজেদের কর্মে অনঢ়ও। একবার নিজেদের এমন ম্যাজিক’শো দেখানোর কথা বাবার কানে এসে পৌঁছালো। এরপর আর কী বাবা শাস্তির জায়গায় নিয়ে গেলেন। বলাবাহুল্য, আমরা ভাই-বোনদের শাস্তির জন্য একটা নির্দিষ্ট জায়গা ছিল। সেটা মেইন ঘরের এক দেওয়ালের পাশে। দেওয়ালে দাঁড় করিয়ে শাস্তি দিতেন বাবা। সেই জায়গার কথা শুনামাত্রেই আমাদের চোখ জলে ভরে যেতো। কিন্তু সেদিন আর চোখে জল দেখেও বাবা ছাড় দেননি। অগত্যা জলভরা চোখে বাবার কড়া শাসন সহ্য করে বাবাকে এমন কাজ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম।
দশমীর বিসর্জনের পর মনটা ক্রমশ ভারী হয়ে পড়ত। তবে তা স্কুল-টিউশন শুরুর জন্য। স্কুল যদিও বন্ধ থাকতো কারণ তখন পুজোর বন্ধের সময়সীমা একমাস থাকতো। পূজা শেষ মানেই পড়াশোনা ফুল স্যুইংয়ে চালু। তখন অপেক্ষায় থাকতাম কালীপুজোর। আমাদের পাড়ায় সেইসময়ে বেশ ঘটা করেই কালীপুজো হতো। কিন্তু দুর্গাপুজা থেকে কালীপুজা অবধি যে সময় ছিল, সেই সময়টুকুতে পড়াশোনা থেকে ছাড় পাওয়া তা ভাগ্যের ব্যাপার ছিল।
প্রতিবছরেই চার-পাঁচটে দিনের জন্য দেবী মহামায়া বাবার বাড়িতে আসেন। হাতেগোনা মাস দুয়েক থেকেই পূজা কমিটিগুলোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। অনলাইন-অফলাইনেও শোপিংয়ের ধুম পড়ে যায়। কিন্তু ছোটবেলার সেই পুজোর আনন্দটা যেনো আর কোথাও পাইনা। সেই ভালোলাগা মূহুর্তটা যতো বড় হচ্ছি ততোই বড্ড মিস করছি। এমনকি পুজার কেনাকাটা নিয়েও কোনো উৎসাহ নেই। তবে বড়দেরকে নিজের রোজগারে কিনে দিতে উৎসাহটা দ্বিগুণ হয়েছে। মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্র কৃষ্ণের চণ্ডীপাঠ, আগমনী গান, দুরদর্শনের সম্প্রচারিত হওয়া মহালয়া দেখি কিন্তু ছেলেবেলার সেই আমেজটা নেই। তখন বিগবাজেটের থিমের কোনও কম্পিটিশন ছিল না কোনো পূজা কমিটির, তবুও ভরপুর আনন্দ ছিল। সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু পাল্টে যায়। আমাদের জীবন থেকেও অনেক কিছু পাল্টে গেছে, আগামীদিনে আরও পাল্টাবে। পুজো আসবে, অনেক স্মৃতি ঢেলে দিবে। আর আমার মতো স্মৃতিকাতর মানুষরা স্মৃতি রোমান্থন করে উৎসবের অর্থ খুঁজে নিয়ে বলবে “যা–দেবী–সর্বেভূতেষু….।”