শীতকালীন সবজিতে শুঁয়োপোকার আক্রমণ ও বৈজ্ঞানিক সচেতনতা

।। মিতা দাসপুরকায়স্থ।।
(শিলচর)
৮ ডিসেম্বর : শীতের বাজার মানেই ফুলকপি ও বাঁধাকপি। আমাদের রান্নাঘরের অন্যতম প্রধান দুই সবজি। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, ফুলকপি কাটতে গিয়ে মাঝখানে লুকিয়ে থাকা বাদামি বা ধূসর রঙের শুঁয়োপোকা বেরিয়ে আসে, কিংবা ফুলগুচ্ছের মধ্যে জমে থাকা ছোটো ছোটো বাদামি দানার মতো কণা চোখে পড়ে। আধুনিক ভোক্তা সমাজে যে কোনো অপ্রত্যাশিত দৃশ্যই আতঙ্ক জাগায়। সমাজমাধ্যমে প্রায়ই এমন ছবি ছড়িয়ে পড়ে, সঙ্গে আতঙ্ক, ক্ষোভ এবং ভুল ধারণার জন্ম হয়। বাজারের প্রতি মানুষের আস্থা নড়বড়ে হয়ে ওঠে। প্রশ্ন ওঠে : এই সবজি কি খাওয়া নিরাপদ ? ভুল করে যদি কেউ শুঁয়োপোকা বা তার মল খেয়ে ফেলে ? ক্ষতি কতখানি ?
এই সবজিগুলিতে যে পোকাটি প্রধানত দেখা যায়, তার বৈজ্ঞানিক নাম Spodoptera litura। সাধারণভাবে পরিচিত Armyworm বা ফলকৃমি নামে। এটি একটি নিশাচর পোকার (Noctuidae) লার্ভা। এরা ফুলকপি, বাঁধাকপি, ধান, লাউ, করলা, ঢেঁড়স সহ বহু শাকসবজি আক্রমণ করে এবং নরম অংশ কেটে খায়। কাটার সময় যে দানাদার বাদামি কণা দেখা যায়, তা লার্ভা নয়, বরং শুঁয়োপোকার মল, যাকে বলা হয় Frass। এটি গাঢ় বাদামি বা কফির রঙের দানার মতো কঠিন কণা। বহু মানুষ এটিকে ছোট পোকা ভেবে আতঙ্কিত হন, যা ভুল ধারণাকে আরও ঘণীভূত করে।

কিন্তু, মূল প্রশ্নটি হলো—এতে কি মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে ?
বৈজ্ঞানিকভাবে বললে—এই শুঁয়োপোকা নিজে মানুষের জন্য বিষাক্ত নয়। বিশ্বজুড়ে বহু জায়গায় (জাপান, কোরিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) বিভিন্ন প্রজাতির শুঁয়োপোকাকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং সেগুলোকে বলা হয় high–protein food source। গবেষণায় দেখা গেছে, শুঁয়োপোকায় থাকে উচ্চমাত্রার প্রোটিন, vitamin B12, iron এবং অপরিহার্য amino acid। সুতরাং, রান্নার সময় ভুল করে কেউ যদি সামান্য লার্ভা খেয়ে ফেলেন, সাধারণত শরীরে কোনো ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে না। বরং তা প্রোটিন হিসেবেই শোষিত হয়।

সমস্যাটি আসলে পোকাটির কারণে নয়, বরং তার মল ও পুরোনো কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ–এর কারণে। Frass–এ নানা জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে এবং যদি আক্রান্ত সবজিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তবে সেটাই প্রকৃত বিপদের কারণ। অপরিষ্কার অবস্থায় এসব গ্রহণ করলে পেটের অসুখ, ডায়রিয়া, ফুড ইনফেকশন ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। অর্থাৎ, সমস্যার উৎস শুঁয়োপোকা নয়, আমাদের উদাসীনতা ও  আতঙ্ক।

অতএব, সঠিকভাবে ধোয়া ও সিদ্ধ করার পর এই সবজি খাওয়া নিরাপদ। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত, ফুটন্ত জলে ১০০°C তাপমাত্রায় ২–৫ মিনিট সিদ্ধ করলে সব ধরনের ব্যাকটেরিয়া, জীবাণু ও সম্ভাব্য পরজীবী ধ্বংস হয়। রান্নার সময় ১৫০–২০০°C তাপে ভাজা হলে ঝুঁকি আরও কমে। ফলে, রান্না করা খাবারে সেভাবে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না। এই কারণেই বলা যায়—ভুল করে যদি কয়েকটি frass বা লার্ভা থেকে যায়ও, রান্না করলে তার ক্ষতিকর প্রভাব কার্যত শূন্য। কিন্তু পরিষ্কার না করে কাঁচা অবস্থায় খাওয়াটা অবশ্যই স্বাস্থ্যসম্মত নয়।

এ পর্যায়ে আরেকটি গভীরতর প্রশ্ন সামনে আসে, আমাদের কৃষিজমিতে ক্রমবর্ধমান রসায়ন নির্ভরতা কি আমাদের জন্য প্রকৃত বিপদ ? শুঁয়োপোকা বা armyworm প্রকৃতিতে একটি জীবচক্রের অংশ। কিন্তু অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার পোকাদের প্রতিরোধশক্তি বাড়িয়ে তোলে, মাটি এবং খাবারে বিষাক্ত উপাদান জমা করে এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে। ফলে সমাধানের পথ হল— জৈব চাষ, Integrated Pest Management (IPM), আলোক-ফাঁদ, নিম তেল এবং জীবাণুভিত্তিক BT টক্সিনের মতো নিরাপদ প্রযুক্তিকে উৎসাহিত করা। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে এভাবে : ভয় নয়, বিজ্ঞান। আতঙ্ক নয়, সচেতনতা।
ভোক্তা, কৃষক, প্রশাসন এবং গণমাধ্যম—সবাইকে একইসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। সামাজিক মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়ানো সহজ কিন্তু দায়িত্বশীল তথ্য প্রচার করা আজকের সময়ের সবচেয়ে বড় মানবিক কর্তব্য। ভয়ের ভাষা নয়, যুক্তির ভাষাই সমাজকে নিরাপদ করে।
সবশেষে বলতে হয় : আমাদের খাদ্যশস্যে জীবন আছে, আমাদের সচেতনতায় স্বাস্থ্য আছে, সর্বোপরি  বিজ্ঞানের পথে আমাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *