বন্যার জলে ডুবছে বাংলাদেশ, ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উত্তাল রাজধানী
২২ আগস্ট : প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন একবার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, “আমাদের বিজয়, ভারতের বিজয় ভারতের বিজয়, আমাদের বিজয়।”
তার এ কথাটি সত্য ও সার্থক হতে পারতো একটি শব্দ পরিবর্তন করলে। আর তা হলো,
“শেখ হাসিনার বিজয়, ভারতের বিজয়
ভারতের বিজয়, শেখ হাসিনার বিজয়।”
কেননা জুলাই বিপ্লব পরবর্তী ভারতীয় আচরণ ও পদক্ষেপে তারা প্রমাণ করেছে,
“শেখ হাসিনার পরাজয়, ভারতের পরাজয়
ভারতের পরাজয়, শেখ হাসিনার পরাজয়।”
জুলাইয়ের বিপ্লবীরা দাবি করেছে, শেখ হাসিনার পরাজয় এবং ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর প্রতিশোধ নিতে এবং ‘হাসিনার বাংলাদেশ’ পুণঃপ্রতিষ্ঠা করতে একের পর এক প্রতি বিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভারত। সেনাবাহিনীতে, বিচার বিভাগে এবং ১৫ আগস্ট প্রতি বিপ্লবের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর পরাজিত সরকারের অনুগত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি দাওয়ার অজুহাতে অসহযোগিতার মাধ্যমে আরেকটি প্রতি বিপ্লব সংগঠনের চেষ্টা দেশে চলমান রয়েছে।
কিন্তু ছাত্র জনতা ও দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে খুব বেশি সুবিধা করে উঠতে না পেরে ভারত প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছে। প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুস ক্ষমতা নেয়ার পূর্বে ভারতীয় টিভি চ্যানেলে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, যদি বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হয়, তাহলে পার্শ্ববর্তী কেউ স্থিতিশীল থাকবে না। মিয়ানমার, পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্ব ভারত তথা সেভেন সিস্টার্স অস্থিতিশীল হবে, যদি বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হয়। প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্যের আনুষ্ঠানিক প্রতিউত্তর ভারতীয় মহল থেকে না দেয়া হলেও তার এই বক্তব্য যে সাম্রাজ্যবাদী দিল্লির বুকে তপ্ত লোহার পেরেকের মত বিদ্ধ করেছিল, তা সহজেই অনুমেয়।
সেকারণে ভারতের দিক থেকে প্রথম ও কার্যকর আঘাত এল উত্তর-পূর্ব ভারত তথা সেভেন সিস্টার্স থেকেই। এবং সেটা এলো ভারতীয় পানি আগ্রাসনের মাধ্যমে। ৫৪টি নদী ভারতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আন্তর্জাতিক আইনে বাধ্যবাধকতা থাকলেও বাংলাদেশের কোন অনুমতির তোয়াক্কা না করেই ভারত এই সমস্ত নদীতে এক বা একাধিক বাঁধ নির্মাণ করে শুকনো মৌসুমে পানি আটকে বাংলাদেশকে মরুকরণের দিকে ঠেলে দেয় এবং বর্ষা মৌসুমে একবারে এসব বাঁধ খুলে বাংলাদেশকে ডুবিয়ে মারে।
ভারতের ত্রিপুরাতে অতি বৃষ্টি হওয়ার অজুহাতে বাংলাদেশকে কোনরূপ তথ্য ও পূর্ব সর্তকতা ছাড়াই অকস্মাৎ বিভিন্ন বাঁধ ছেড়ে দিয়ে মুহুরী গোমতী খোয়াই নদী জল সুনামির মত ঢুকেছে সীমান্তবর্তী ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খাগড়াছড়ি জেলায়। জল ঢুকতে শুরু করেছে সিলেট হবিগঞ্জ সুনামগঞ্জ মৌলভীবাজার জেলায়। সিকিমে তিস্তা বিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধে রহস্যজনক ধস নামায় আতঙ্কে আছে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার মানুষ।
এই মুহূর্তে উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব বাংলাদেশ ইতিহাসের ভয়াবহতম বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। ভারত থেকে নেমে আসা জলের স্রোত এতই তীব্র যে সেখানে সাধারণ নৌকা ইঞ্জিন চালিত নৌকা দিয়ে উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। একমাত্র স্পিডবোট ও হেলিকপ্টার ছাড়া উদ্ধার তৎপরতা চালানো যাচ্ছেনা। কিন্তু স্পিডবোট ও হেলিকপ্টারে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। দুর্গত জেলাগুলোর পেট্রোল পাম্পগুলো ডুবে যাওয়ায় স্পিডবোট ইঞ্জিন চালিত নৌকাগুলো জ্বালানি সংকটের কারণে অনেক ক্ষেত্রে অচল হয়ে পড়েছে। ভারতীয় বন্যার জলের সঙ্গে জোয়ারের সময় সাগরের জল যুক্ত হয়ে বন্যার জলের উচ্চতা লোকালয়ে বাড়ির ছাদ পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছে। অতি দ্রুত জল প্রবেশ করায় অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেনি, অনেকেই স্বাভাবিক বন্যা মনে করে আশেপাশের উঁচু স্থানগুলোতে অবস্থান নিলেও অতি দ্রুত বিপুল পরিমাণ জল সেই সব উঁচু স্থানগুলো গ্রাস করে ফেলে। ফলে বর্তমান বন্যায় হতাহতের সঠিক পরিমাণ এই মুহূর্তে কেউ নিশ্চিত করতে পারছে না। ভারত বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকলেও ভারতের এই জল আগ্রাসনে দুর্গত এলাকার কয়েক লক্ষ সংখ্যালঘু ইতিমধ্যেই নিঃস্ব হয়ে গেছে বন্যার পানিতে। তাদের মন্দির গুলো এবং মন্দিরে থাকা দেব-দেবী বন্যার পানিতে ধ্বংস হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের মানুষ কোন পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই ভারতের এই বাঁধ খুলে দিয়ে সৃষ্ট পানি আগ্রাসন সহজ ভাবে গ্রহণ করেনি। ইতোমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় সাধারণ জনগণ ভারতের এই হীন কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে। গত রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ভারতের এই নোংরা চালের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। আজ একই প্রতিবাদে ভারতীয় দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচি পালনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষণা করা হয়েছে। এটি যে একটি ষড়যন্ত্র তার প্রমাণ পাওয়া যায় এদেশীয় এক ভারতীয় অনুচরের ফেসবুক পোস্ট থেকে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় এদেশীয় ভারতীয় এক অনুচরের সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট থেকে। Sugata Saha নামের এই ব্যক্তি তার সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে লিখেছেন, ‘কীরে! তোরা বলে বাংলা, বিহার, ওড়িষা, সেভেন সিস্টার্স দখল করে অখণ্ড বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবি। এক Dumboor Gate খুলে দেওয়ার পর কাত হয়ে গেলি!!! Barking dog seldom bites. গান্ডু আগা কাটার দল।’
ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেটাগোরিকরা একের পর এক ভারতের এই ঘৃণ্য অপকর্মের প্রতিবাদে পোস্ট দিচ্ছেন। জুলাই বিপ্লবের নায়কেরা তাদের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলগুলোতে এর প্রতিবাদ করেছেন সরাসরি। এদের মধ্যে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল সমন্বয়ক ও বর্তমানে তথ্য, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকারী নাহিদ ইসলাম ফেসবুকে একাধিক পোস্ট দিয়েছেন। সর্বশেষ পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘২০২৪ আমাদের অনেক কিছু দেখিয়ে দিয়েছে,আর নিতে পারছি না!’ আরেক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের এক প্রহর আনন্দে কাটলে, এক ঋতু কেটে যায় বিষণ্ণতায়!’
ভারতের পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে কোনরূপ কূটনৈতিক ভাষার ধার না ধেরে তিনি সরাসরি লিখেছেন, ‘ভারত আমাদের শত্রু এই কথাটা যে-ই প্রজন্ম বুঝতে পারবে তাঁরাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান!’
অন্য এক পোস্টে তিনি লিখেছেন,’ “ভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র”, আমার ছোট্ট জীবনে শোনা সেরা মিথ্যা কথা এটা।’
ভারতের এই আগ্রাসনের প্রতিবাদে তিনি লিখেছেন, ‘তিস্তা প্রকল্প চীনকে দিলে ভারত সোজা হয়ে যাবে৷’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘ভারত, বাংলাদেশকে নিয়ে চিন্তা করার কোনও প্রয়োজন নেই! বাংলাদেশ পরিচালনা করছেন একজন নোবেল জয়ী। চা বিক্রেতা নয়!’
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে নিকৃষ্টতম গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা কে আশ্রয়, নোটিশ ছাড়াই ওয়াটার গেইট খুলে দিয়ে বন্যার সৃষ্টি করা ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতির কারণ হতে পারে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণের কাছে স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে হবে।’
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম লিখেছেন, ‘প্রতিবেশী, বন্ধু, শত্রু এসব আলাপ বাদ ৷ ভারতের নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপ, বাংলাদেশের সাথে ভারতের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নির্ধারণ করবে ৷’ তিনি ভারতকে উল্লেখ করে সরাসরি লিখেছেন, ‘মহান রব, রহম করো আমাদের। এই ভারতের কড়াকড়ি হিসেব দিতে হবে,বলে দিলাম।’ আরেক সমন্বয়ক হাসানাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, ‘যখন জল প্রয়োজন তখন দিচ্ছে না যখন জল প্রয়োজন নেই তখন বাঁধ খুলে দিচ্ছে।’
উপরোক্ত ফেসবুক পোস্টগুলো থেকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কী বুঝতে পারছেন, তারা তাদের পেটের মধ্যে বাংলাদেশ জন্ম দিচ্ছে? তাদের ভুল পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশকে যে পথে ঠেলে দিচ্ছে এর দায় কাদের? যদিও বাংলাদেশের মানুষ ভারতকে একটি সু প্রতিবেশী হিসেবেই দেখতে পছন্দ করে।
প্রকৃতপক্ষে এই বাংলাদেশকে ভারত বুঝতে সক্ষম হচ্ছে না। জেনারেশন জি, এবং নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ বলে যে বাংলাদেশকে দাবী করা হচ্ছে, সেই বাংলাদেশের জন মনোভাব বুঝতে ভারত সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। যে কারণে তার পূর্বের নীতি ও ধ্যান ধারণা চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ ২.০ কারো আগ্রাসন, দাদাগিরি, আধিপত্যবাদ মেনে নিতে প্রস্তুত নয় এটা ভারত বুঝতে সম্পূর্ণ অক্ষম। ফলে জুলাইয়ের পরাজয়ের যে রিটালিয়েটরি যেসব পদক্ষেপগুলো নিচ্ছে তা বাংলাদেশের মানুষকে আরও বেশি ভারত বিদ্বেষী করে তুলছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ভারতবিদ্বেষ চরমে উঠেছে। এর জন্য দায়ী একের পর এক ভারতের ভুল পদক্ষেপ।
ভারতের এই জল আগ্রাসন বাংলাদেশের মানুষ সহজভাবে মেনে নিতে পারছে না। তারা দাবি করেছে বাংলাদেশ এর যথোপযুক্ত জবাব দিক। কোনরূপ পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই ও বাংলাদেশের নদীগুলোর সক্ষমতা এবং নদী অববাহিকায় বসবাসকারী মানুষের পরিণতির কথা বিবেচনা না করে একসাথে বিপুল পরিমাণ পানি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে ডুবিয়ে মারাকে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হিসাবে বিবেচনা করে বাংলাদেশ বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে বিষয়টি তুলে ধরুক। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের এই অন্যায় আচরণ বিশ্বের মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন বিদেশী গণমাধ্যমগুলোকে উপদ্রুত এলাকায় পরিদর্শনের ব্যবস্থা করুক।
শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশ ভারতের সাথে যে সমস্ত জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী এবং বৈষম্যমূলক চুক্তি করেছে তা বাতিল করার দাবি উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিশেষ করে, বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে সড়ক, রেল ও নৌ ট্রানজিট বাতিল করে দেয়ার দাবি উঠেছে। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার ও চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে উত্তর পূর্ব ভারতে যে সকল ট্রানজিট সুবিধা দেয়া হয়েছে সেগুলো অবিলম্বে বাতিল করার দাবি উঠেছে। বাংলাদেশের চিকেন নেক খ্যাত ফেনীর পাশে ভারতের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ওপর চরম হুমকি সৃষ্টিকারী তা অবিলম্বে বাতিল করা হোক। ভারত যদি অনতিবিলম্বে এই জল বন্ধ না করে তাহলে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাথে বাংলাদেশের সকল স্থলবন্দর বন্ধ করে দেয়া হোক।
খবর : দৈনিক ইনক্লাব পত্রিকা।