করিমগঞ্জে ‘ভাষা গৌরব সপ্তাহ’ উদযাপন বাংলা সাহিত্যসভার
পিএনসি, করিমগঞ্জ।
বরাক তরঙ্গ, ১২ নভেম্বর : বাংলা সাহিত্যসভা অসম এর করিমগঞ্জ শাখার আয়োজনে ‘ভাষা গৌরব সপ্তাহ’ উদযাপন উপলক্ষে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে মুখ্য অতিথি হিসেবে যোগদান করেন বাংলা সাহিত্যসভা, অসম এর রাজ্য সভাপতি খগেনচন্দ্র দাস, মুখ্য বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সভার রাজ্য সম্পাদক তথা কটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বরিষ্ঠ অধ্যাপক ড০ প্রশান্ত চক্রবর্তী। উপস্থিত ছিলেন সাহিত্যসভার শিলচর শাখা সভাপতি সমরবিজয় চক্রবর্তী, রাজ্য সহকারী সাধারণ সম্পাদক সন্দীপন দত্ত পুরকায়স্থ! মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন করিমগঞ্জ শাখার প্রধান উপদেষ্টা ডা০ সুরজিত দাসও। উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও অনুবাদক রুনুমী শর্মা, শিলচর শাখার কোষাধ্যক্ষ অনিমেষ দেব, উপস্থিত ছিলেন সাহিত্যসভার অন্যতম আইনি পরামর্শদাতা অগ্নিজিৎ ভট্টাচার্য প্রমুখ।
সান্ধ্য সাংস্কৃতিক সভার শুরু হয় শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনিতে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে! দীপমন্ত্রের উচ্চারণে এক অনন্য পরিবেশের সৃষ্টি হয়! এরপর ছিল সাহিত্যসভার সহযাত্রীদের পরিবেশিত উদ্বোধনী সংগীত ‘ মোদের গরব মোদের ভাষা আমরি বাংলা ভাষা’-পরিবেশন করেন বর্ষীয়ান শিল্পী সুব্রত খাজাঞ্চি (টুলু), অলকা দে স্বামী, মৌসুমী দাস বণিক, অর্পিতা দে, মঞ্জুরী চৌধুরী ও শ্রাবণী পাল।
সাহিত্য জন্মজিৎ, শিল্পে মাধুরী, ভাষা সংগ্রামে সুখেন্দু কে সম্মাননা
এরপরই ছিল সুব্রত খাজাঞ্চির একক কন্ঠের পরিবেশন’ মোরা যাত্রী একই তরণীর ‘, শিল্পী উল্লেখ করেন যে একটি রাজ্যের দু-দুটি ভাষা, আমাদের বাঙালিদের মাতৃভাষা বাংলা ও ধাত্রী ভাষা অসমিয়া একই সময়ে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে এটা একটা বিশেষ বড় পাওয়া এবং এই সময়ে বরাক-ব্রহ্মপুত্রের সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে সত্যিকারের সাঁকো নির্মাণের সহায়ক, আমরা সত্যিই একই তরণীর যাত্রী। রবিবার শাখা সভানেত্রী ড০ শর্মিষ্ঠা খাজাঞ্চির পৌরহিত্যে সভায় সাধারণ সম্পাদক শুভ্রাংশু প্রকাশ দে-র স্বাগত ভাষণ ও অতিথি বরণের মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠানের সূচনা ঘটে। উল্লেখ্য যে এই সভায় ‘ ভাষা গৌরব সপ্তাহ ‘ উপলক্ষে তিনটি ভিন্ন ক্ষেত্রে তিনজন বর্ষীয়ান ব্যক্তিত্বদের সম্মান জানানো হয়। কবি-লেখক-সাহিত্য ব্যক্তিত্ব সর্বজন শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত ড০ জন্মজিৎ রায়, বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী মাধুরী পোদ্দার এবং একষট্টির ভাষা সংগ্রামী সুখন্দু বিকাশ পালকে শ্রদ্ধা-সম্মান জানানো হয়! প্রসঙ্গত ডা০ জন্মজিৎ রায় অসুস্থতার কারণে মঞ্চে উপস্থিত থাকতে পারেন নি বলে উনার গৃহে গিয়েই তাঁকে সম্মান জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
অতিথিদের মধ্যে শিলচর শাখার সভাপতি সমর বিজয় চক্রবর্তী উনার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষা স্বীকৃতির বহু প্রচেষ্টা ও আবেদনের মধ্যে গত ২৩ জুলাই ২০২৩ এ গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত কার্যনির্বাহী সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাংলা সাহিত্যসভার পক্ষ থেকে ধ্রুপদী ভাষা স্বীকৃতির দাবি সম্বলিত আবেদন প্ত্র পাঠানো ও বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের তদ্বির জানানোটাও নিছক কাকতালীয় ছিল না, এটি এই স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে নিশ্চিতই অনুঘটকের কাজ করেছে। মুখ্য অতিথি রাজ্যিক সভাপতি খগেনচন্দ্র দাস বাংলা সাহিত্যসভা সভা গঠনের প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেন। রাজ্যস্তরে বাংলা ও বাঙালির জন্য একটা মঞ্চের প্রয়োজন যে শুধু বাঙালি চিন্তাশীলদের মননেই ঘুরপাক খাচ্ছিল তাই নয় বিভিন্ন অসমীয়া বুদ্ধিজীবীদেরও ভাবিত করেছিল বলে উনি মত প্রকাশ করেন। করিমগঞ্জ শাখার সভানেত্রী ড০ শর্মিষ্ঠা খাজাঞ্চি তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে বাংলা ভাষার মাহাত্ম্য তুলে ধরেন! ভাষা সংগ্রামী সুখেন্দু বিকাশ পাল সংক্ষেপে -৬১-র ভাষা সংগ্রামের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
মুখ্যবক্তা ড০ প্রশান্ত চক্রবর্তীর কথা শোনার অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকা দর্শক শ্রোতারা হাততালি ও হর্ষোল্লাসের মাধ্যমে ড০ চক্রবর্তীকে স্বাগত জানান মাইক্রোফোন হাতে তুলে নেবার পর! পরবর্তী চল্লিশ মিনিট একটি অসাধারণ বক্তৃতায় প্রেক্ষাগৃহ ঠাসা শ্রোতারা আবিষ্টমন ছিলেন। কখনও মঞ্চে কখনও দর্শকদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রমিত বাংলা ও সিলেটিতে বলে মাতিয়ে গেলেন। করিমগঞ্জেরই ভূমিপুত্র, অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক গল্প উপন্যাসিক সৈয়দ মুজতবা আলীর জীবন ও সাহিত্যকৃতির উপর ডক্টরেট করা উনার ভাব শিষ্য ড০ চক্রবর্তী করিমগঞ্জের মাটিকে প্রণাম জানিয়ে একে একে বাংলা ভাষার বিভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে সুরম্য আলোচনা করেন।
ড০ চক্রবর্তী বলেন, আধুনিক বাঙালি জাতি গঠনে যিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন সেই মহাপুরুষ শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুকে এই মুহূর্তে স্মরণে রাখা প্রতিটি বাঙালির খুবই প্রয়োজন, বাঙালিদের আদি অকৃত্রিম ইতিহাস জানতে হবে। আঞ্চলিক ভাষাগুলোই বাংলা ভাষার অলঙ্কার, উপভাষা বলে খাটো করা উচিত নয়। মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা করলে সকল ভাষাকে শ্রদ্ধা করা যায়। অন্যান্য সকল ভাষাকে সম্মান জানানো ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের দ্বারা পুষ্ট হবার এবং সহযোগী ভাষার সমৃদ্ধির সহযোগিতার স্বীকৃতি এই ধ্রুপদী ভাষা, যা বহু ব্যবহারেও কখনও পুরাতন হয় না হবে না। সকল ভাষা শিক্ষাই গৌরবের, তবে চিবিয়ে চিবিয়ে ইংরেজি বলার অহমিকায় দু’শ বছরের দাসত্ব বা গোলামী মানসিকতার প্রতিফলন ঘটে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়-ইংরেজি আমাদের কাজের ভাষা, ভাবের ভাষা নয়, উল্লেখ করে বাংলা ভাষা চর্চা প্রসারে সবাইকে এগিয়ে আসার কথা বলে গানে, উপনিষদের শ্লোকে, হাস্যরসে শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে গেলেন, এত তথ্যবহুল ও আবেগ মিশ্রিত কথার এমন প্রাঞ্জল উপস্থাপন উপস্থিত সকলকে শুধু মুগ্ধই করেনি, চিন্তারও খোরাক জুগিয়েছে।
এরপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেন নবগীতিকা সাংস্কৃতিক সংস্থার ছাত্রীরা, ‘আমি বাংলায় গান গাই’ নৃত্যরূপ পরিবেশিত হয়। এরপর শিল্পীরা বৌ নাচ ও পরম্পরাগত ধামাইল পরিবেশন করেন। ধামাইলের তালে দর্শকেরাও প্রেক্ষাগৃহে তাল মিলিয়ে দুলতে থাকেন। সাংস্কৃতিক নৃত্যানুষ্ঠানের পরিচালনায় ছিলেন বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী পারমিতা পাল বণিক, তাকে উত্তরীয় দিয়ে বরণ করেন বাংলা সাহিত্যসভার রাজ্য সভাপতি খগেনচন্দ্র দাস। করিমগঞ্জ শাখার পক্ষে সহসভাপতি দিপ্তী দাস দে, কোষাধ্যক্ষ মালবিকা ভট্টাচার্য, সাংস্কৃতিক সম্পাদক দিপালী দেব, কার্যকরী সদস্য ড০ বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য-দের পরিচালিত সমগ্র অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন জয়ন্ত দাস এবং রাজ্য সমিতির সদস্য তথা বিশিষ্ট ভাস্কর শিল্পী কিশোর দে।