বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনার ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা বরাকের পরিচয় বদলেরই ষড়যন্ত্র : বরাকবঙ্গ

হাঁসজারু সংস্কৃতি নয়, শ্রদ্ধাবোধে দৃঢ় হোক সম্প্রীতি

বরাক তরঙ্গ, ২৫ মে : বরাক উপত্যকার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, জনবিন্যাসের চরিত্র, উনিশের চেতনায় সমৃদ্ধ। তার আত্মপরিচয় এবং অধিকার রক্ষার সংগ্রামের ধারাবাহিক ইতিহাস বদলের চেষ্টা সময়ে সময়ে ভিন্ন রূপে দেখেছে এই উপত্যকা। ফের একবার সেই কূটকৌশল দেখা যাচ্ছে। রবিবার   বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন এ কথা তুলে ধরে  বলেছে, সুদীর্ঘকালের সংগ্রামের অন্যতম ফসল আসাম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনার  ইতিহাস বিভিন্ন তরফে বদলের এবং চেপে যাওয়ার ক্রমাগত প্রয়াসের নবায়িত উদ্যমে যড়ষন্ত্রের যে কালোমেঘ দেখা যাচ্ছে তা গভীর উদ্বেগের  সঞ্চার করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনার  ইতিহাস নিয়ে আপাতনিরীহ কথাবার্তা যে একেবারে উদ্দেশ্যহীন নয় সে সম্পর্কে উপত্যকাবাসীকে সতর্ক থাকতে আহবান জানিয়েছে সম্মেলন।

বরাকবঙ্গের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গৌতম প্রসাদ দত্ত এদিন  এক বিবৃতিতে এই আহ্বান রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিকৃতির বিষয়টি  নিয়ে উপত্যকা জুড়ে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে তাকে সঙ্গত বলে মন্তব্য করেছেন। বলেছেন, উনিশের রক্তঝরা দিনে গোটা উপত্যকা এবং দেশ -বিদেশের বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলের মানুষ ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে সংগ্রামের স্রোতধারাকে বহমান রাখার জন্য নতুন করে যখন অঙ্গীকার নিচ্ছিলেন তখন সেদিন উপত্যকার  আত্মমর্যাদায় আঘাত করার জন্য আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চ ব্যবহারের সুযোগ প্রদানের ঘটনা এই ভূমির চিন্তাশীল ব্যক্তিদের শঙ্কিত করে তুলেছে।

বরাকবঙ্গের সাধারণ সম্পাদক গৌতম প্রসাদ দত্ত বিবৃতিতে  আরও বলেছেন, একষট্টি সালে ভাষার অধিকার রক্ষার দুর্বার গণ-আন্দোলন এই উপত্যকার স্বাধিকার চেতনার যে উন্মেষ ঘটিয়েছিল, বাহাত্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যম, ছিয়াশিতে বিদ্যালয়গুলোতে  ভাষা শিক্ষা চাপানোর নির্দেশিকা এই অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন দাবির স্ফুরণ ঘটিয়েছিল। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাকের পড়ুয়াদের ক্রমাগত নিগ্রহ এই দাবিকে প্রাসঙ্গিক করে তোলে। তখন থেকেই  বরাক উপত্যকা শিক্ষা সংরক্ষণ সমিতি এই  অঞ্চলে একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবিতে যে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল তা ক্রমেই বিভিন্ন সংগঠনের নিজস্ব উদ্যোগে সর্বাত্মক চেহারা নেয়। ছাত্র সংগঠন আকসা আন্দোলনকে বিশেষ মাত্রা দিয়েছিল।

বরাকবঙ্গের সাধারণ সম্পাদক দত্ত বিবৃতিতে এসব কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এই  সময়কালে বিদেশি বিতাড়ন আন্দোলনের নেতা ও তাদের মন্ত্রণাদাতারা একটিবারও বরাকের এই দাবির সমর্থনে কথা না বলে উল্টো বিরোধিতা করেছেন । তখনই উপত্যকার জননেতা সন্তোষ মোহন দেব দিল্লিতে রাজনৈতিকভাবে তৎপর হয়ে ওঠার পর ১৯৮৯ সালে বিস্তর বাধা ডিঙিয়ে    তৎকালীন রাজীব গান্ধী সরকার আসাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করে । এই আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় অসম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নেতারা সংসদের ভেতরে ও বাইরে এবং  এ রাজ্যে বিলটির বিরোধিতা করেছিলেন । পাঁচ বছর প্রতীক্ষার  পর ১৯৯৪ সালে ২১ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাও যখন দরগাকোনায় আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের  স্থাপনায় এসেছিলেন তখন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার উগ্র জাতিপ্রেমী নেতাদের মন রাখতে  ফলকের আবরণ উন্মোচন ছাড়াই  শুধু সভা করে ফিরে যান। ফলে অনানুষ্ঠানিকভাবেই আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এই ইতিহাস কোনও পর্যায়েই বলে না যে, আসাম বিশ্ববিদ্যালয় অসম আন্দোলনের সুবাদে এসেছিল। ১৯৮৫ সালে স্বাক্ষরিত আসাম চুক্তির ৭ নং দফার বয়ানে কোথাও আসাম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা নেই। যখন এতসব করেও আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা রোধ করা গেল না, তখনই শুরু হয়ে গেল ইতিহাস বিকৃতি। এরই সূত্র ধরে ২০২০ সালের ২৫ ডিসেম্বর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে এসে প্রতিষ্ঠানকে অসম আন্দোলনের ফসল বলে মন্তব্য করেন। বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য সংস্কৃতি সম্মেলন সহ একাধিক সংগঠন সেদিন মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু এরপরও বিভিন্নভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারা বদলের চেষ্টা অব্যাহত থেকে গেছে, যার নবতম সংস্করণ দেখা গেল গত উনিশ মে বিশ্ববিদ্যালয়ে চত্বরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উচ্চারিত বার্তায়। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যক্রমে বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে অসমিয়া ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থাও রয়েছে এবং কেউ তাতে কোনওদিন আপত্তি তোলেনি এই সত্য চেপে বাহবা নেওয়ার চেষ্টাও দেখা গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনার ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা বরাকের পরিচয় বদলেরই ষড়যন্ত্র : বরাকবঙ্গ

বিবৃতিতে বরাকবঙ্গের সাধারণ সম্পাদক গৌতম প্রসাদ দত্ত সংগ্রামের ইতিহাস টেনে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চে এক আমন্ত্রিতের বয়ান দলমতের উর্ধ্বে উঠে উপত্যকার সর্বস্তরের মানুষ একবাক্যে খারিজ করে দিয়ে সংগ্রামী চেতনার আরও একবার প্রমাণ দিলেন। এজন্য তিনি সবাইকে বরাকবঙ্গের তরফে সংগ্রামী অভিনন্দন জানান।  সঙ্গে তিনি এও বলেছেন, প্রলোভনের হাতছানি দিয়ে যাঁরা উপত্যকার সংগ্রামী চেতনাকে দুর্বল করে দিতে হাঁসজারু সংস্কৃতির আমদানি করতে চাইছেন এবং এ অঞ্চলের যাঁরা এই প্রয়াসের শরিক হয়ে উঠছেন উপত্যকার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এদের সবার ভূমিকা সম্পর্কে জনগণের সতর্ক থাকা প্রয়োজন।

সাধারণ সম্পাদক দত্ত এই আহ্বান রেখে বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের অবস্থান  স্পষ্ট করে বলেছেন, বরাকবঙ্গ বাঙালি জাতিসত্তায় বিভাজনের সমস্ত প্রয়াসের বিরোধী। পাশাপাশি এই উপত্যকা তথা গোটা রাজ্যে বসবাসকারী প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মর্যাদা ও সম্প্রীতির এক সুস্থ আবহ গড়ে উঠুক, এটাও চাইছে। গত উনপঞ্চাশ বছর ধরে সম্মেলনের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে এই বার্তাই দেওয়া হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

Author

Spread the News