মহালয়া : পিতৃপক্ষের অবসান, দেবীপক্ষের শুরু
।। শুভ দাস, করিমগঞ্জ।।
বরাক তরঙ্গ, ১ অক্টোবর : আশ্বিনের শারদপ্রাতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অনির্বচনীয় কণ্ঠস্বর রেডিওতে বেজে উঠলেই বাঙালির জীবনে সূচিত হয় মহালয়া, মহালয়া অর্থাৎ মহান যে আলয়, এই কথাটির ব্যাখ্যা নানা ভাবে করেছেন প্রাজ্ঞজনেরা। যেহেতু মহালয়া থেকেই দেবী দূর্গার আবাহন মুহূর্তটি চিহ্নিত হয়ে যায়, তাই অনেকের মতে দেবী স্বয়ং হলেন এই আলয় বা আশ্রয়। ভিন্নমতে, এই মহান আলয় হল পিতৃলোক। যেহেতু এটি পিতৃপক্ষের অবসান চিহ্নিত করে। ঠিক এর পরদিন থেকে দেবীপক্ষের সূচনা। আহ্বান। রেডিও থেকে ভেসে আসতে থাকে তাঁর স্বর্গীয় কণ্ঠধ্বনি। সমগ্র বাঙালি সমাজকে সূর্যোদয়ের মধ্যে দিয়ে জাগিয়ে তুলে তিনি পাঠ আরম্ভ করেন।মাঝে মাঝে গান হত। সঙ্গে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সহ বড় বড় সব শিল্পীর গান। ছোটবেলায় সব মিলিয়ে কিছুই বুঝতাম না তেমন, সেরকম বোঝার মতো মানসিতা তৈরী হয়নি তখনও কিন্তু মহালয়ার আনন্দে মেতে ওঠার উৎসাহ ছিল ঢের। কেমন যেন একটা জাদু থাকতো ঐ চণ্ডীপাঠ আর গানের মধ্যে। গীতিকাব্য শুনতে শুনতে সকালে সূর্যোদয় দেখতাম, আর ক’দিন পরেই দুর্গা পূজা। পূজার আগাম বার্তা। আর নতুন জামার গন্ধ। বাঙালির মনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের নাম। তার দরাজ কণ্ঠে চিন্ময়ীকে আহবান না শুনলে আমাদের মহালয়া শুরু হয় না এখনো। এমনকি শুধু বাংলায় নয় সুদূর আমেরিকা কানাডা ইউরোপ অস্ট্রেলিয়া বিভিন্ন দেশে সারা বিশ্বে যত বাঙালি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রত্যেকেই মহালয়া বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে গান শুনে মহালয়া শুরু করে। অনেক আগে ডিডি বাংলা ছাড়া আমাদের আর অন্য কোন চ্যানেল ছিলনা। পরবর্তীকালে বিভিন্ন রকম টিভি চ্যানেলে মহালয়া দেখার সুযোগ হয়েছে। সেই সময় মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গতিনাশিনী বিভিন্ন অনুষ্ঠান পর্বের আয়োজন থাকতো টেলিভিশনে। তবে ডিডি বাংলার সেই মহালয়া আজও ভোলার নয়। এক সময় ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ গানটি শুরু হলেই আমার ছোট্টমনে অনাবিল শান্তির ছোঁয়া লাগত। ঐ মুহূর্ত থেকেই আনন্দ যেন ছুঁয়ে যেত আমার চারধারের পৃথিবী। এভাবেই বড় হয়েছি, সংসারী হয়েছি, জীবনের প্রতিটি দিনে নানা রকম পরিবর্তন এসেছে। ছোটবেলার অনুভূতির সাথে বড়বেলার অনুভূতিতেও পরিবর্তন এসেছে। রাস্তায় রাস্তায় না হেঁটে বিছানায় বসেই মহালয়ার দেবী বন্দনা শুনেছি। জীবনের পরবর্তি ধাপগুলো পেরিয়ে আরও পরিনতির দিকে এগিয়েছি, জীবনের প্রয়োজনে,
এই বার আসা যাক, মহালয়ায়। পিতৃতর্পণ, দেবতর্পণে। আসলে এই সব পুরুষপ্রদত্ত অস্ত্রশস্ত্রে ভূষিত দেবীর বিজয়ই নারীশক্তির জয়। মহামতি আকবরের সময়কালে রাজশাহীর তাহিরপুরে রাজা কংসনারায়ণ যে দুর্গাপূজা করেন, যার পুরোহিত ছিলেন রমেশ শাস্ত্রী কিংবা পরবর্তীকালে পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন প্রাচীন দুর্গাপূজার সঙ্গে মহালয়ার সে রকম সখ্য ছিল না। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ থেকে এর উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে উল্লেখ আছে, দেবী দুর্গার যুদ্ধের আহ্বান শুনে মহিষাসুর লালসা প্রকাশ করে। সেই অপমান সহ্য করতে না পেরে দেবী ওই অসুরকে হত্যা করেন। এর মূলে জয়ের আকাঙ্ক্ষা ছিল না, ছিল অপমানের বদলা নেওয়ার বাসনা।
মহালয়াকে কেন নারীশক্তির বিজয় বলে ধরা হয়? কী তার কারণ? এখানে তো নারীর কোনও উল্লেখ নেই সেই বিশেষ অর্থে। যা আছে, তা হল—অপরপক্ষ। আশ্বিনের শুক্লপক্ষের পূর্ব কৃষ্ণপক্ষ। এই কালো পক্ষর মধ্যে কি লুকিয়ে আছে শুক্লপক্ষ বা বিজয়ের ভাবনা? সে সব কথা পাওয়া যেতে পারে নানা শাস্ত্রে। যদি আমরা দুর্গাপূজাকে রাজা সুরথের কিংবা বৈশ্য সমাধির পূজা বলে ধরে নিই, যা হয়েছিল মেধা মুনির আশ্রমের কাছে নদীর তীরে; তার নিয়মনীতি কিংবা কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণে (বাল্মীকির রামায়ণে রামের দূর্গাপূজার কথা নেই) বর্ণিত পূজাপ্রণালী এক ও অভিন্ন নয়। ব্রহ্মবৈবর্ত, দেবীভাগবত পূরাণের মধ্যেও পূজার যজ্ঞের তফাৎ রয়েছে। সুরথ রাজাকে প্রজারা তাড়িয়ে দিলেও তিনি তাদের ভালমন্দের জন্য কাতর ছিলেন, সমাধিও চিন্তিত ছিলেন অকৃতজ্ঞ পরিবারের সদস্যদের জন্য। তাই তাঁরা মহামায়ার সাধনা করেন। আশ্বিনী অমাবস্যায় সেই সাধনার শুরু ছিল না, তা ছিল বাসন্তী পূজা। শারদীয়া দুর্গাপূজা অকাল বোধন।
“প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা, আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি। অসীম চাঁদে বেজে ওঠে রুপ লোক ও রস লোক এ আনে নব ভাবমাধুরী সঞ্জীবন, তাই আনন্দিত শ্যামলী মাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ী তে আবাহন।”