মোহাম্মদ জনি, পাথারকান্দি।
বরাক তরঙ্গ, ২৮ ডিসেম্বর : হিন্দু রাষ্ট্র ভাবনায় উদ্দীপ্ত হয়ে শ্রীভূমি জেলার বাজারিছড়ায় রবিবার এক বিশাল ও ভাবগম্ভীর হিন্দু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।স্থানীয় এলাকার কালাছড়াস্থিত রাধারমণ সেবক সংঘ প্রাঙ্গণে এই সম্মেলনের আয়োজন করে বাজারিছড়া মণ্ডল। ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ এই সম্মেলনে এলাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করেন। দুপুর প্রায় দুইটা নাগাদ ভারত মাতার প্রতিকৃতিতে প্রদীপ প্রজ্বলন ও পুষ্পার্ঘ্য নিবেদনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়। এই মহতি অনুষ্ঠানের শুরুতেই রাধারমণ সেবক সংঘের কার্যকর্তারা উপস্থিত অতিথিদের গামছা পরিয়ে এবং শ্রীমদ্ভগবদগীতা উপহার দিয়ে আন্তরিকভাবে বরণ করে নেন।সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন বাজারিছড়া রাধারমণ সেবক সংঘের সভাপতি সূচরিত পাল। সভাপতির স্বাগত ভাষণের মধ্য দিয়েই মূল আলোচনা পর্বের সূচনা হয়। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, “হিন্দু সমাজের ঐক্য, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়কে আরও সুদৃঢ় করার লক্ষ্যেই এই সম্মেলনের আয়োজন। এরপর পর্যায়ক্রমে হিন্দু ধর্ম, সংস্কৃতি, দর্শন ও জাতীয় চেতনা নিয়ে সারগর্ভ বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট বক্তারা। বক্তব্য রাখেন শ্রীভূমি জেলা সদরের সরস্বতী বিদ্যানিকেতনের প্রধান আচার্য অঞ্জন গোস্বামী, নিলামবাজার সরস্বতী বিদ্যানিকেতনের প্রধান আচার্যা পূরবী দে, এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের শ্রীভূমি জেলা কার্যবাহ মনোজ দাস প্রমুখ।
অঞ্জন গোস্বামী তাঁর বক্তব্যে বলেন, “হিন্দু বিচারধারা ও হিন্দুত্বের আহ্বানে আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি—এটি আমাদের সকলের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। তিনি বলেন, “পৃথিবীতে ভারত যখন একটি দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল, তখন অন্য অনেক দেশের অস্তিত্বই ছিল না। সেই কারণেই সুপ্রাচীন কাল থেকে ভারতবর্ষ তার নিজস্ব সভ্যতা ও সংস্কৃতি নিয়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
তিনি আরও বলেন, “হিন্দুরা পুনর্জন্মে বিশ্বাসী। জন্মজন্মান্তরে এই দেশের নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়েও আমরা টিকে থেকেছি। তাই আমরা ন আদি, ন অন্ত।” হিন্দু ও হিন্দুত্বের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “হিন্দু একটি জাতিবাচক শব্দ। হিমালয় থেকে সিন্দু সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত যে ভূখণ্ড, সেটাই হিন্দুস্থান। সেই ভূখণ্ডের অধিবাসীরাই হিন্দু।তিনি হিন্দুত্বকে ব্যাখ্যা করে বলেন, হিন্দুত্ব হলো হিন্দু চেতনা, সংস্কৃতি ও দর্শনের সম্মিলিত রূপ যা বহু বিচারধারার সমাবেশ।এরপর প্রধান আচার্যা পূরবী দে ভারতমাতার নামে জয়ধ্বনি দিয়ে তাঁর বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, “আমরা যারা হিন্দু, আমাদের সবাইকে একত্রিত হয়ে একটি তেজস্বী ও শক্তিশালী হিন্দু রাষ্ট্রের পুনর্নির্মাণে এগিয়ে আসতে হবে।তিনি বলেন, “আজকের ভারতবর্ষ খণ্ডিত ভারতবর্ষ। এই ভগ্ন অংশকে পুনরায় গড়ে তুলতে হবে।

বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “ভারত মায়ের বুকে আমরা কতদিন হিন্দু পরিচয়ে থাকতে পারব এই প্রশ্ন আজ গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই তিনি হিন্দু সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।ইতিহাসের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, অতীতে যেখানে ভারতীয় সংস্কৃতি ধ্বংস হয়েছে, সেই সব অঞ্চল বৃহত্তর ভারতবর্ষের মানচিত্র থেকে মুছে গেছে।এরপর রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের জেলা কার্যবাহ মনোজ দাস তাঁর বক্তব্যে বলেন, “রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের শতবর্ষ উপলক্ষে দেশজুড়ে এ ধরনের সম্মেলনের আয়োজন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, “আমাদের দেশ দীর্ঘকাল পরাধীন ছিল। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভারতবর্ষ একসময় সব ক্ষেত্রে অগ্রগামী ছিল। তবুও হাজার বছর পরাধীন থাকতে হয়েছে—এর কারণ অনুসন্ধান করেছিলেন ডাক্তারজি। তিনি বলেন, “ডাক্তারজি উপলব্ধি করেছিলেন যে মূল হিন্দু সমাজের মধ্যে সংগঠনের অভাব ছিল। স্বামী বিবেকানন্দও বলেছিলেন প্রথমে সংঘবদ্ধ হতে হবে, মানুষ গড়ার সংঘ তৈরি করতে হবে এবং ভারত মায়ের পূজা করতে হবে। ডাক্তারজির হাত ধরে এই তিনটি বিষয়ই বাস্তব রূপ পায়। তিনি আরও বলেন, “যাঁরা ভারতের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বসবাস করেন, দেশকে শ্রদ্ধা করেন এবং দেশের সুখে সুখী ও দুঃখে দুঃখী হন—তাঁরাই হিন্দু।” এই হিন্দু সমাজকে সংগঠিত করার লক্ষ্যেই ১৯২৫ সালে নাগপুরে বিজয়া দশমীতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের সূচনা হয়। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে সংঘ আজ শতবর্ষ অতিক্রম করেছে। সম্মেলনের শেষ পর্বে সভাপতি সূচরিত পাল সকল অতিথি ও অংশগ্রহণকারীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বৃহত্তর হিন্দু সমাজের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, “আমাদের ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদগীতা গোটা বিশ্বকে মুক্তির পথ দেখায়। সনাতন ধর্মের মূল চেতনা হলো বিশ্ব মঙ্গলার্থে প্রার্থনা।এই সম্মেলনে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের কার্যকর্তা ঘনশ্যাম কৈরি, শ্রীভূমি জেলা সহ-শারীরিক প্রমুখ সুজয় পাল, সমাজকর্মী তুষার ভট্টাচার্য, অজিত ঘোষ, বাজারিছড়া রাধারমণ সেবক সংঘের সম্পাদক দেবজ্যোতি নাগ, বাপ্পা চক্রবর্তী প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সুচারুভাবে পরিচালনা করেন আশ্রম কমিটির সদস্য অমিতাভ দে।


