মোহাম্মদ জনি, শ্রীভূমি।
বরাক তরঙ্গ, ২ ডিসেম্বর : স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐহিত্যমণ্ডিত করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তন প্রতিরোধ নাগরিক কমিটির আহ্বানে করিমগঞ্জের জেলা গ্রন্থাগার ভবনে সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধি নিয়ে করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের অন্যায় ও একপেশে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে চলমান আন্দোলনকে আরও তীব্রতর করার লক্ষ্যে এক গণ অভিবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। নাগরিক কমিটির অন্যতম আহ্বায়ক যথাক্রমে সুনীতরঞ্জন দত্ত, বদরুল হক চৌধুরী, সুদীপ্তা দে চৌধুরী এবং পরিমল চক্রবর্তী ও তুষার পুরকায়স্থকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলীর পরিচালনায় বক্তব্য রাখেন মহান কবি ও শিল্পী এবং সাহিত্যিক রূপকোঁওর জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালার ভ্রাতুষ্পুত্রী ও মহিলা সবলীকরণ আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী, সমাজ কর্মী মিনাক্ষী ভূঁইয়া, এপিডিসিএল এর প্রাক্তন ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ও সমাজ কর্মী বিমল দাস, মানকাচর কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও শিক্ষা আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা প্রদীপ মহাপাত্র নাম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সাধুবাদ জানান এবং এই আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী দীর্ঘস্থায়ী সংগঠিত রূপ দিতে উপস্থিত জনসাধারণকে আহ্বান জানান।

এছাড়াও আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে বক্তব্য রাখেন নাগরিক কমিটির অন্যতম আহ্বায়ক রজত চক্রবর্তী, প্রাক্তন মন্ত্রী আবু সালেহ নজমুদ্দিন, আইনজীবী সুব্রত কুমার পাল, সমাজকর্মী জ্যেতিষ পুরকায়স্থ, অধ্যাপক অজয় রায়, সমাজকর্মী শিহাব উদ্দিন, সমাজকর্মী আব্দুল কালাম তাপাদার, সহ বিশিষ্টজনেরা। অভিবর্তনের শুরুতে করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে গত ১২ ফেব্রুয়ারি বরাক উপত্যকার বিশিষ্ট জনদের উপস্থিতিতে করিমগঞ্জ জেলার সংগ্রামী নাগরিকদের নিয়ে গঠিত স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐহিত্যমণ্ডিত করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তন প্রতিরোধ নাগরিক কমিটির ধারাবাহিক আন্দোলন এবং বিশেষ করে ৬ সেপ্টেম্বরের ঐতিহাসিক করিমগঞ্জ জেলার সাধারণ ধর্মঘটে জনগণের স্বতস্ফুর্ত সমর্থনের বিষয় উল্লেখ করে নাগরিক কমিটির অন্যতম আহ্বায়ক আইনজীবী অরুণাংশু ভট্টাচার্য বলেন, এই আন্দোলন সাধারণ মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরির চক্রান্তের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। গণ অভিবর্তনের মূল প্রস্তাব উত্থাপন করেন নাগরিক কমিটির কার্যকরী কমিটির অন্যতম সদস্য পিকলু দাস দে। মূল প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয় যে উগ্রপ্রাদেশিকতাবাদী -সাম্প্রদায়িক রাজ্য সরকার সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধি নিয়ে করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের যে স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল, এর বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে জেলার জাতি ধর্ম ভাষা বর্ণ নির্বিশেষে জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সভা, সমাবেশ, মিছিল, স্মারকপত্র প্রদান ইত্যাদি সংগঠিত হয়েছে এবং গত ৬ সেপ্টেম্বর আন্দোলনের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ হিসাবে সফল ধর্মঘট পালনের মধ্য দিয়ে আন্দোলন আজ এক শক্তিশালী রূপ পরিগ্রহ করেছে। দেশ আজ এক ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন। অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশে আজ গভীর সংকট নেমে এসেছে। মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি বেকার সমস্যা চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। মানুষের জীবন জীবিকা সংক্রান্ত সকল রাস্তা আজ রুদ্ধ। রাজনীতি আজ কলুষিত। দুর্নীতি চরম সীমায় গিয়ে পৌঁছেছে।

এসবের বিরুদ্ধে যাতে ঐক্যবদ্ধ গণ আন্দোলন গড়ে উঠতে না পারে, তার জন্য ক্রমাগত সাম্প্রদায়িকতার আগুন দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভাষা ও ধর্মের নামে সংখ্যালঘু জনসাধারণের উপর ক্রমাগত আঘাত হানা হচ্ছে। রাজ্যের উগ্র- প্রাদেশিকতাবাদী সাম্প্রদায়িক সরকারও একই ভাবে গরিব মানুষের বেঁচে থাকার পথকে রুদ্ধ করে দিচ্ছে। ক্ষমতার স্বার্থে জনসাধারণের সমস্যাগুলোকে আড়াল করতে ভাষা ও ধর্মের নামে প্রতিদিন বিভেদ সৃষ্টির চক্রান্ত চলছে। উগ্রাদেশিকতাবাদী- সাম্প্রদায়িক সরকারের তীব্র আগ্রাসনে বরাক উপত্যকার জনসাধারণ আজ বিপর্যস্ত। রাস্তাঘাট, পানীয়জল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সবকিছুই আজ গভীর সমস্যায় জর্জরিত। উপত্যকায় কোন শিল্প উদ্যোগ গড়ে উঠছে না। কাগজ কল, চিনি কল ইত্যাদি উদ্যোগগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পূর্ণরূপে স্তব্ধ হয়ে আছে। নতুন কাজকর্ম সৃষ্টি করার কোন প্রচেষ্টা সরকার গ্রহণ করছে না। শিক্ষিত ছাত্র যুবকদের কর্মসংস্থান প্রায় শূন্য তে নেমে এসেছে। বৈষম্য আজ চরম সীমায় এসে পৌঁছেছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে স্থানীয়দের বঞ্চিত করার সরকারি চক্রান্ত আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট। চা বাগান গুলোর অবস্থা উদ্বেগজনক। চা শ্রমিকদের স্থায়ী চাকরি ক্রমশঃ তুলে দিয়ে ঠিকভিত্তিক চাকরিতে নিয়োগ করা হচ্ছে। আজ একদিকে আসামের অসমিয়া ভাষার বিকাশ অক্ষুন্ন থাকা সত্ত্বেও উগ্রপ্রাদেশিকতাবাদী -সাম্প্রদায়িক সরকার ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলা ভাষার মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করছে, মারাত্মকভাবে সংকুচিত করছে। বাংলাভাষী সংখ্যালঘুদের মাতৃভাষার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। একই সাথে বরাক উপত্যকায় ভাষা শহীদদের আত্ম বলিদান এর মধ্য দিয়ে যে ভাষার অধিকার অর্জিত হয়েছে, তাকেও কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে এবং বাংলা পঠন -পাঠনে অসমীয়া শব্দ জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়ারও প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। তাছাড়া সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে ডি লিমিটেশন করে বরাক উপত্যকার দু’টি বিধানসভাকে অন্যায়ভাবে হরণ করে উপত্যকার জনগণের ন্যায্য অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অথচ সরকার এই সমস্ত সমস্যার কোন ইতিবাচক সমাধান না করে, এই সমস্যাগুলোকে আড়াল করতে মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টি করে শুধুমাত্র ক্ষমতার লিপ্সায় এই নাম পরিবর্তনকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছে।

আজকের এই অভিবর্তনে জেলার প্রতিটি প্রান্ত থেকে উপস্থিত সংগ্রামী জনগণের পক্ষ থেকে জোরালো দাবি উত্থাপিত হয় যে অবিলম্বে নাম পরিবর্তন প্রত্যাহার করে জেলার বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করতে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় এই আন্দোলন ক্রমাগত শক্তিশালী গণ আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করবে।
আজকের এই গণতান্ত্রিক নাগরিক অভিবর্তন উগ্রপ্রাদেশিকতাবাদী -সাম্প্রদায়িক সরকারের এই চূড়ান্ত বিভাজনবাদী মানসিকতা নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্যমন্ডিত করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা এই গণ আন্দোলনে জাতি, ধর্ম, ভাষা, বর্ণ নির্বিশেষে জনসাধারণের ব্যাপক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দুর্বার রূপ পরিগ্রহ করে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য করিমগঞ্জ জেলা সহ বরাক উপত্যকার সংগ্রামী জনসাধারণের কাছে আবেদন জানানো হয়। সভার শেষে কমিটির অন্যতম সদস্য প্রজ্জ্বোল দেব আজকের এই অভিবর্তনে উপস্থিত ব্রহ্মপুত্র ও বরাক উপত্যকার বিশিষ্ট জন সহ অভিবর্তনে উপস্থিত জনসাধারণ এবং আমরা করিমগঞ্জী সংগঠন ও অন্যান্য সকল সদস্যদের আন্তরিক অভিনন্দন জানান।


