সংবিধান বাঁচাও দিবস উপলক্ষে করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেসে আলোচনা সভা_____
মোহাম্মদ জনি, শ্রীভূমি।
বরাক তরঙ্গ, ২৬ নভেম্বর : আজকের দিনটি কেবল একটি স্মরণ দিবস নয় এটি হল ভারতের আত্মাকে নতুন করে অনুভব করার দিন। ২৬ নভেম্বর, করিমগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ইন্দিরা ভবন পরিণত হল এক গভীর জাতীয় চেতনার মন্দিরে, যেখানে একত্রিত হলেন প্রবীণ নেতৃবৃন্দ, ছাত্র-যুব প্রজন্ম, সামাজিক কর্মী ও গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ। সংবিধান বাঁচাও দিবসের এই বিশেষ অনুষ্ঠানে যেন আবারও সেই মুহূর্তগুলি জীবন্ত হয়ে উঠল যখন একদল স্বপ্নদ্রষ্টা ভারতকে দিয়েছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সংবিধান। আলোচনার মঞ্চে উঠে আসল স্বাধীনতার গৌরব, সংবিধানের মহিমা, এবং ন্যায়-সমতা-মানবিকতার নতুন অঙ্গীকার ২৬ নভেম্বর বুধবার সংবিধান বাঁচাও দিবস উপলক্ষে করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেস কার্যালয়, ঐতিহ্যবাহী ইন্দিরা ভবন-এ এক বর্ণাঢ্য, মর্যাদাপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ সভার আয়োজন করা হয়। সমবেত নেতৃবৃন্দ, বিশিষ্ট নাগরিক, ছাত্র-যুব প্রতিনিধিগণ এবং কংগ্রেস পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানস্থল হয়ে ওঠে জাতীয় চেতনার গভীর আবহে আবিষ্ট।
সভায় প্রথম বক্তৃতা শুরু করেন জেলার প্রবীণ নাগরিক ও প্রাক্তন জেলা কংগ্রেস সভাপতি সতুরায়। তিনি সংবিধান দিবসের ঐতিহাসিক তাৎপর্য তুলে ধরে বলেন আজকের এই দিনটি শুধু ক্যালেন্ডারের একটি তারিখ নয়—এটি স্বাধীন ভারতের আত্মা, ভবিষ্যৎ দিশা এবং রাষ্ট্রের মৌলিক দর্শনের প্রতীক। আজ আমরা স্মরণ করি সেই মহাগ্রন্থকে ভারতীয় সংবিধানকে যা আমাদের মুক্ত গণতন্ত্রের ভিত্তি, আমাদের অধিকার ও দায়িত্বের মূলমন্ত্র।তিনি বলেন, সংবিধান তৈরির পথ ছিল কঠিন এবং দীর্ঘ। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলেও ন্যায়ভিত্তিক শাসন কাঠামো তখনও গঠিত হয়নি। ব্রিটিশ শাসনের আইন—বিশেষত ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন—এক স্বাধীন দেশের স্বপ্ন ও মানসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। তাই ১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রথমবার বসে সংবিধান সভা, সেখান থেকেই শুরু হয় আধুনিক ভারতের জন্মযাত্রা।সংবিধান সভার সভাপতি ছিলেন ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, আর সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন আধুনিক ভারতীয় রাজনীতির আলোকপুরুষ ড. ভীমরাও আম্বেদকর। তাঁর সঙ্গে ড্রাফটিং কমিটিতে ছিলেন বহু বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব এন. গোপালস্বামী আইয়াঙ্গার, আল্লাদি কৃষ্ণস্বামী আয়ার, কানাইয়ালাল মানেকলাল মুঞ্জি, সৈয়দ মুহাম্মদ সাদুল্লাহ, বিএল মিত্র এবং পরে যোগদানকারী টিটি কৃষ্ণমাচারি।তারা সম্মিলিতভাবে প্রায় ২ বছর ১১ মাস ১৮ দিন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম, সর্বাধিক অন্তর্ভুক্তিমূলক ও আধুনিক সংবিধান প্রস্তুত করেন।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সংবিধান কেবল আইনবহুল পুস্তক নয়, এটি এক অনন্য শিল্পসম্পদ। পুরো সংবিধানটি হস্তলিখিত। শান্তিনিকেতনের শিল্পীগোষ্ঠী, নন্দলাল বসু ও রামমোহন সিংহের নেতৃত্বে প্রতিটি পৃষ্ঠা অলংকৃত করেন। ভারতীয় ঐতিহ্য থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস সবই প্রতিফলিত হয়েছে এর নান্দনিক শিল্পচিত্রে। এরপর তিনি সংবিধানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে বলেনএটি বিশ্বের দীর্ঘতম লিখিত সংবিধান, যেখানে ভারতীয় সমাজের বৈচিত্র্য বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতি ও অঞ্চল গভীরভাবে প্রতিফলিত। এতে রয়েছে আমেরিকার মৌলিক অধিকার, বৃটেনের সংসদীয় গণতন্ত্র, আয়ারল্যান্ডের রাষ্ট্রনীতির নির্দেশমূলক নীতির প্রভাব, তবে সবই ভারতীয় বাস্তবতায় রূপান্তরিত। স্বাধীন বিচারব্যবস্থা জনগণকে রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শক্তি দেয়। এবং সবচেয়ে বড় কথা জনগণই রাষ্ট্রশক্তির চূড়ান্ত উৎস।তিনি দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর অনন্য অবদানের কথাও স্মরণ করেন নেহেরু কেবল সংবিধানসভার নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান স্থপতি। তাঁর Objectives Resolution ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার আদর্শগত ভিত্তি স্থাপন করে।
করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি রজত চক্রবর্তী বলেন, নেহেরুর অবজেক্টিভ রিজোলিউশনেই নির্ধারিত হয়েছিল সার্বভৌমত্ব জনগণের হাতে থাকবে, প্রত্যেক নাগরিক সমান অধিকার পাবে, এবং রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক পথেই চলবে। তাঁর আন্তর্জাতিক দৃষ্টি ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ভারতকে গণতান্ত্রিক বিশ্বের অগ্রগামী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

তিনি স্মরণ করিয়ে দেন ২৬ নভেম্বর ১৯৪৯ সালে সংবিধান গৃহীত হয় এবং ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে তা কার্যকর হয়। এই দিন থেকেই ভারত এক সত্যিকারের প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়—যেখানে প্রতিটি নাগরিক একই আইনের অধীনে সমান মর্যাদা লাভ করে।জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক পংকজ নাগ বলেন
সংবিধান আমাদের পথপ্রদর্শক সংসদ থেকে শুরু করে পঞ্চায়েত, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিচারালয় প্রতিটি স্তরে এর নীতি আমাদের রক্ষা করে। তাই সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা মানেই ভারতের সার্বভৌমত্ব, ঐক্য ও গণতান্ত্রিক চরিত্রের সুরক্ষা।জেলা কংগ্রেসের মিডিয়া ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান সাহাদত আহমদ চৌধুরী বলেন সংবিধান আমাদের হাতে দায়িত্ব দিয়েছে একটি ন্যায়ভিত্তিক, বিজ্ঞানমনস্ক, মানবিক ও সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার। যে সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন ড. আম্বেদকর, জওহরলাল নেহেরু, ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, সরদার প্যাটেল, মওলানা আজাদ এবং অগণিত জাতিনির্মাতা।
অন্যান্য বক্তারা বলেন, সংবিধান দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত গণতন্ত্রকে রক্ষা করা, মানবিকতার পথে চলা এবং ভারতকে এমন এক রাষ্ট্রে পরিণত করা—যা সত্যিই জনগণের, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য।
এরপর তারা সংবিধানের প্রস্তাবনার অঙ্গীকার উচ্চারণ করেন আমরা, ভারতের জনগণ, দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ করিতেছি যে ভারতকে এক সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত করিব এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়; চিন্তা, মত, বক্তব্য, বিশ্বাস, ধর্ম ও উপাসনার স্বাধীনতা; মর্যাদা ও সুযোগের সমতা সকল নাগরিককে নিশ্চিত করিব।সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা কংগ্রেসের সহ-সভাপতি বিশ্বজিৎ ঘোষ। সভা পরিচালনা করেন প্রশাসনিক সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ কুরি। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী জ্যোতিষ পুরকায়স্থ, একে দাপাদার, একে তালুকদার, অহিরঞ্জন দে, অনুরাগ দত্ত, আব্দুল ওয়ারিশ, জেলা যুব কংগ্রেস সভাপতি নিজামুদ্দিন, এনএসইউআই সভাপতি সুস্মিত দেব, রিনা চক্রবর্তী, ধ্রুবজ্যোতি দাশ, নিপেন্দ্র চন্দ্র দাস, শুভম দাস, হাসিনা রহমান, হোসেন আহমেদ চৌধুরী, রাজা দত্ত বনিক প্রমুখ।


