সম্প্রীতির অনন্য নজির, শ্রীপুরে বিয়ের অনুষ্ঠানে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের মহামিলন
মোহাম্মদ জনি, পাথারকান্দি।
বরাক তরঙ্গ, ৭ জুলাই : আজ যখন গোটা দেশজুড়ে ধর্মীয় বিভাজনের বিষবাষ্পে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে, ঠিক তখনই আশার আলো দেখাল শ্রীভূমি জেলার পাথারকান্দি ব্লকের অন্তর্গত শ্রীপুর গ্রাম। এখানে সম্প্রতি ঘটেছে এমন এক ঘটনা, যা হৃদয়ে উদ্দীপনা জাগায়, চোখে আনে জল, এবং প্রমাণ করে—ভারতবর্ষে মানবতার আলো এখনও নিভে যায়নি।
রবিবার ও সোমবার দু’দিনব্যাপী আয়োজন করা হয়েছিল শ্রীপুর গ্রামের বিশিষ্ট বাসিন্দা ও পাথারকান্দি সমবায় সমিতির প্রাক্তন সম্পাদক প্রদীপ দেবের একমাত্র মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান। এ আয়োজন কেবল একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ ছিল না এটি পরিণত হয়েছিল এক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মহামঞ্চে।

উক্ত বিগ বাজেটের বিলাশী বিবাহ অনুষ্ঠানে আশপাশের গ্রাম থেকে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রায় এক হাজারেরও বেশি মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। শুধু অতিথি হয়ে নয়—তাঁরা নিজেরাই এই বিয়ের অনুষ্ঠানকে সফল করে তোলার জন্য দিনরাত এক করে কাজ করেন। কেউ মণ্ডপ নির্মাণে সহযোগিতা করেন, কেউ রান্নাবান্নার কাজে, কেউ আবার অতিথি আপ্যায়নে। এমনকি বিয়ের দিনে ও আগের দিন গায়ে হলুদের দিন গান ‘বরযাত্রী’দের যাত্রায় বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নেছে গেয়ে উৎসবের আবহ তৈরি করতেও দেখা যায় মুসলিম যুবকদের।
গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মেহেদি, ফুল দিয়ে সাজসজ্জায় মেতে ওঠে। বৃদ্ধ মুসলিমরা মেয়ের বাবাকে আশীর্বাদ করতে এগিয়ে আসেন, আর যুবসমাজ নেয় সমস্ত দায়িত্ব।

এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রীপুর গ্রাম যেন নিজেই হয়ে ওঠে একটি জীবন্ত ক্যানভাস যেখানে একদিকে সনাতন ধর্মের বিয়ের রীতি পালন হয়, অন্যদিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের সহানুভূতি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মাধ্যমে সেই রীতির প্রতি পূর্ণ সম্মান জানিয়ে পাশে দাঁড়ায়।
এই মহামিলন ছিল এমনই এক ছবি, যেখানে ধর্মের গণ্ডি অতিক্রম করে মানুষ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এখানে কেউ হিন্দু বা মুসলমান ছিল না—ছিল শুধু “মানুষ।
একজন স্থানীয় প্রবীণ মুসলিম ব্যক্তি আবেগে ভাসিয়ে বলেন,“প্রদীপদা আমাদের পরিবারের মতো। তাঁর মেয়ের বিয়ে মানেই আমাদের ঘরের বিয়ে। আমরা কোনও ভেদাভেদ দেখি না, এটাই আমাদের শ্রীপুর।
প্রদীপবাবু নিজেও আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, এত বড় আয়োজনে আমি একা কখনও সামলাতে পারতাম না। আমার মুসলিম ভাই-বোনেরা যেভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে, তা আমি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভুলতে পারব না। বলেন, এই বিয়েটা আমার মেয়ের হলেও, আনন্দটা ছিল গোটা গ্রামের। আমার সনাতনী হিন্দু, মণিপুরি সহ মুসলিম ভাই-বোনেরা যেভাবে নিঃস্বার্থভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে, তা দেখে আমার চোখে জল এসেছিল। মণ্ডপ গড়ার হাত থেকে শুরু করে অতিথি আপ্যায়ন—সব জায়গায় ওদের আন্তরিকতা দেখে মনে হয়েছে, আমরা শুধু প্রতিবেশী নই, আমরা একে অপরের আত্মীয়। আজ মনে হচ্ছে, ধর্ম আমাদের আলাদা করে না—ভালোবাসা, সম্মান আর সহানুভূতিই আমাদের সত্যিকারের পরিচয়। শ্রীপুর আজ শুধু আমার মেয়ের বিয়ের সাক্ষী নয়, শ্রীপুর আজ ইতিহাসের অংশ হয়ে গেল সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে।