লক্ষীপুরের গ্রাম নিয়ে প্রতিবাদ জানালে ‘গুজব’ বলা হয়েছিল, আজ সত্যি হল : প্রদীপ দত্তরায়

বরাক তরঙ্গ, ২৮ আগস্ট : লক্ষীপুরের উনিশটি গ্ৰাম ডিমা হাসাও’-এ অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে বিডিএফের মুখ্য উপদেষ্টা প্রদীপ দত্তরায় বললেন দু’বছর আগের ‘গুজব’ আজ সত্যি হচ্ছে। তিনি বলেন, ২০২৩ সালের ২৭ এপ্রিল কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের সঙ্গে ডিমা হাসাও জেলার জঙ্গি সংগঠন ‘ডিমাসা ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির ( ডিএনএলএ)’ ত্রিপাক্ষিক চুক্তি দিল্লিতে স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তি মতে, সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘ডিমাসা ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল’ গঠনের কথা রয়েছে। এই কাউন্সিল গঠনের মূল লক্ষ্য হল, ডিমা হাসাও জেলার গা ঘেঁষে থাকা অন্য জেলার যেসব গ্ৰাম বা বস্তিতে ডিমাসাদের বসতি রয়েছে সেগুলোকে ডিমা হাসাও জেলার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা।

দু’বছর আগে দৈনিক সংবাদপত্রে আমরা এ নিয়ে দীর্ঘ প্রতিবেদন ছেপেছিলাম। এ নিয়ে তখন প্রচণ্ড বিতর্ক হয়। মুখ্যমন্ত্রীকে দিয়ে বিবৃতি জারি করানো হয়, ‘এতে কাছাড় জেলার ভৌগোলিক সীমানায় কোনো পরিবর্তন হবে না’! উধারবন্দের বিধায়ক এই খবরকে “গুজব” বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। সরকারের হয়ে কয়েকজন ব্যাট ধরতে নেমে আমাদের এই প্রতিবেদনকে মিথ্যা প্রমাণ করতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমে পড়েছিলেন।

দু’বছরের মাথায় কী হল, তার তথ্য আজকের খবরে রয়েছে। ওই চুক্তি অনুযায়ী কাছাড় জেলার লক্ষীপুরের উনিশটি গ্ৰাম ডিমা হাসাওকে দিয়ে দেওয়ার সরকারি প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। এই গ্ৰামগুলোকে নিজেদের জেলায় শামিল করতে ডিমা হাসাও স্বায়ত্তশাসিত পরিষদ ইতিমধ্যে সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছে। কাছাড় জেলা প্রশাসনের পক্ষে চিঠি জারি করে ওই গ্ৰামগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত রিপোর্ট জমা করতে বলা হয়েছে। লক্ষীপুর বিধানসভা কেন্দ্রের অধীনে যে গ্ৰামগুলোকে ডিমা হাসাওর অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সেই গ্ৰামগুলো হল, রাজাবাজার উন্নয়ন ব্লকের অন্তর্গত ডিপু, কুমাছড়া, কালীনগর, জেমব্রু, পুঠাছড়া, হরিনগর, ধরমনগর, থাইপুনগর, রাইলিং, মাসাপ, দলইছড়া, সোনপুর, কাড়াবিল, কনকপুর, জয়পুর, ওয়াটিলিং, লাংলাছড়া, লাডুমা এবং লোধি।

বিধানসভা কেন্দ্রের ডিলিমিটেশনের আগে এই গ্ৰামগুলোর বেশ কয়েকটি ছিল উধারবন্দের অধীনে। এখন পড়েছে লক্ষীপুরের। দু’বছর আগের ওই প্রতিবেদনেই আমরা জানিয়েছিলাম, কাছাড়ের লক্ষীপুর, উধারবন্দ, বড়খলা ও কাটিগড়ার পঞ্চাশটির বেশি গ্ৰাম ডিএন‌এলএ চুক্তি অনুযায়ী ডিমা হাসাও জেলাকে দিয়ে দেওয়ার কথা রয়েছে। আজ প্রকাশিত খবরে শুধু লক্ষীপুরের কথা রয়েছে। অনুরূপভাবে অন্য তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রের কয়েকটি গ্ৰামকে ডিমা হাসাওকে দিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে কী না, তা জানা যায়নি।

আপাতত লক্ষীপুরের যেসব গ্ৰামকে কাছাড় থেকে ছেঁটে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, সেইসব গ্ৰামের অসংখ্য বাসিন্দা অ-ডিমাসা। মানে বাঙালি সহ অন্যান্য জাতি জনগোষ্ঠীর। ডিমা হাসাও জেলায় জঙ্গি কার্যকলাপ যখন তুঙ্গে ছিল, তখন এই অঞ্চলের বাঙালি সহ অন্য জনগোষ্ঠীর মানুষকে জান-মাল খোয়ানো সহ নিত্যদিনের হামলার শিকার হতে হয়েছিল। এখন যদি জোর করে সেইসব এলাকা ডিমা হাসাওকে সমঝে দেওয়া হয় তবে সেই এলাকার অ-ডিমাসা মানুষের কী হবে? তাঁরা তো অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বেন।

এছাড়া কাছাড়ের এই সীমান্তবর্তী এলাকা হল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। এই জেলার রাজস্বের একটা বড় অংশ আসে প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে। সেই এলাকাগুলো যদি ডিমা হাসাওকে দিয়ে দেওয়া হয় তবে তো কাছাড় কার্যত নিঃস্ব হয়ে যাবে। সঙ্গে গোটা বরাক উপত্যকা।

ইতিমধ্যেই ডিলিমিটেশনের জেরে আমরা দুটো বিধানসভা কেন্দ্র খুইয়েছি। তখন সবাই চুপ ছিলাম। এখন আস্ত একটা এলাকা পড়শি জেলাকে সমঝে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরপরেও হয়তো চুপ থাকবো। কারণ এটাই এই উপত্যকার নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাত পোহালেই উৎসবের মেজাজে শহর শিলচরে এই দেশের অন্যতম দুই শ্রেষ্ঠ সন্তান নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আর শহিদ মঙ্গল পাণ্ডের মর্মর মূর্তি উৎসবের মেজাজে উন্মোচন হবে। ভুলে গেলে চলবে না, তাঁরা এই দেশের স্বাধীনতার জন্য, মানুষের গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন চেতনার জন্য মহা শক্তিশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়েছিলেন, জীবন আহুতি দিয়েছিলেন। সেই স্বাধীন ভারতবর্ষে যদি আমরা নিজেদের ভৌগোলিক সীমানা রক্ষায় রুখে দাঁড়াতে না পারি, তবে বীর সন্তানদের ওই মূর্তিগুলো শুধু পাথর হয়েই শহরের বুকে দাঁড়িয়ে থাকবে। সেলফি আর ব্লগ করার ঠিকানা হবে। এবং অবশ্যই তাঁদের আদর্শ ও লড়াইর প্রতি উত্তর প্রজন্ম হিসেবে বিশ্বাসঘাতকতা করারই শামিল হবে।

Spread the News
error: Content is protected !!