নাম পরিবর্তন : শ্রীভূমিতে ছাত্র অবস্থান

মোহাম্মদ জনি, শ্রীভুমি।
বরাক তরঙ্গ, ২৩ এপ্রিল : জনমতকে তোয়াক্কা না করে সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধি নিয়ে করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছাত্র অবস্থান পালন করে স্বাধীনতা আন্দোলন ও মাতৃভাষা আন্দোলনের ঐতিহ্যমণ্ডিত করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তন বিরোধী ছাত্র সংগ্রাম কমিটি। বুধবার বেলা ১২ টায় করিমগঞ্জ শহরের গঙ্গা ভাণ্ডারের সামনে এই প্রতিবাদী কার্যসূচি রূপায়ণ করা হয়। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে আগত সংগ্রামী ছাত্রছাত্রী প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে আয়োজিত ছাত্র অবস্থানের সূচনায় কাশ্মীরের পেহেলগামে গতকাল সাধারণ পর্যটকদের উপর নৃশংস গুলী চালিয়ে হত্যার ঘটনার তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। প্রস্তাবে বলা হয় যে উগ্ৰপন্থীদের দ্বারা সংঘটিত এই পাশবিক ঘটনার নিন্দা জানানোর জন্য কোনো ভাষাই যথেষ্ট নয়। আজকের এই ছাত্র অবস্থান থেকে দোষীদের অবিলম্বে গ্ৰেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের জোরালো দাবি জানানো হয়। ছাত্র অবস্থানে উপস্থিত প্রতিনিধিবৃন্দের পক্ষ থেকে এই গভীর শোকের মুহূর্তে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয় ও এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

ছাত্রছাত্রীরা করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিয়ে প্রতিবাদ স্থল উত্তাল করে তুলেন। ছাত্র সংগ্ৰাম কমিটির আহ্বায়ক সঞ্চিতা শুক্লের পরিচালনায় প্রতিবাদী সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমে  বক্তব্য রাখেন কাছাড় কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ও গণ আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা অধ্যাপক অজয় রায়। তিনি বলেন, শিলচর – লামডিং ব্রডগেজ রেললাইন রূপায়ণ হওয়ার পর আশা করা হয়েছিল যে বরাক উপত্যকায় শিল্পায়নের দুয়ার খুলে যাবে। বরং তার বিপরীতে জনগণের কর্মসংস্থান লাভের একমাত্র মাধ্যম ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান কাছাড় কাগজ কল ২০১৫ সাল থেকে বন্ধ, কর্মসংস্থানের কোনও সুযোগ না পেয়ে বরাক উপত্যকার যুবকেরা বহিঃরাজ্যে গিয়ে বেগার খাটতে বাধ্য হচ্ছে। বর্তমান সরকার বরাক উপত্যকার দুটো বিধানসভা কেন্দ্র কমিয়ে দিয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বৃদ্ধি করেছে, করিমগঞ্জ জেলার জেলা পরিষদ কেন্দ্রের সংখ্যা কর্তন করা হয়েছে। বরাক উপত্যকায় যে সব সরকারি কার্যালয় রয়েছে তাতে পূর্বে স্থানীয় বেকার যুবক যুবতীদের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর বিভিন্ন পদে চাকুরী জুটত বর্তমানে নিয়ম পরিবর্তন করে স্থানীয় বেকারদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। সম্প্রতি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর চাকরির সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফলে চরম বঞ্চনার চিত্র ফুটে উঠেছে। রাজ্য সরকারের বাজেটেও বরাক উপত্যকাকে চরম উপেক্ষা করা হয়েছে।  তিনি আরো বলেন, সরকারি স্কুলগুলো শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে, একটার পর একটা স্কুল বন্ধ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, অসমের মধ্যে একমাত্র আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা কলেজগুলোতে ভর্তির জন্য ছাত্র ছাত্রীদের সর্বভারতীয় স্তরের যোগ্যতা নির্ণায়ক ও গরীব ছাত্র স্বার্থবিরোধী সিইউইটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। গতবছর সাম্প্রদায়িক ও উগ্ৰপ্রাদেশিকতাবাদী অভিসন্ধি নিয়ে বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলায় এই পরীক্ষার কেন্দ্র স্থাপন করা হয়নি। বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করা ছাত্রছাত্রীদের অসমিয়া, বড়ো বা ইংরেজি ভাষায় পরীক্ষা দিতে বাধ্য করা হয়েছে। এছাড়াও বাংলা বিষয়ের পরীক্ষা কেন্দ্র গুয়াহাটি, ডিব্রুগড়, কোকড়াঝাড় বা শিলং, আইজল, আগরতলায় স্থাপন করা হয়েছিল। ফলে ছাত্রছাত্রীদের চরম আর্থিক হেনস্তার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তিনি এই জ্বলন্ত সমস্যাগুলোর সমাধান করার দাবিতে ও অন্যায়, অযৌক্তিক ও চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আহ্বান জানান।

নাম পরিবর্তন : শ্রীভূমিতে ছাত্র অবস্থান

প্রাক্তন শিক্ষক ও বিশিষ্ট নাগরিক সুনীত রঞ্জন দত্ত  বলেন যে বরাক উপত্যকার যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে মেডিকেল কলেজ, জেলা হাসপাতাল ইত্যাদির দুরবস্থা দেখলেই আসাম সরকারের উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব ও বৈষম্যের চিত্র ফুটে উঠে। উগ্ৰ প্রাদেশিকতাবাদী শক্তির মদতপুষ্ট সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে পরিচালিত বর্তমান সরকার তার সীমাহীন বৈষম্যমূলক চরিত্র আড়াল করতে সুকৌশলে  বিভাজনের রাজনীতি তীব্রতর করছে যাতে জনগণের জীবন ও জীবিকার জ্বলন্ত সমস্যাগুলো নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে না উঠে। এই চক্রান্তের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করে গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হিসেবে প্রাপ্য অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হওয়ার পাশাপাশি করিমগঞ্জ জেলার অন্যায় ও অগণতান্ত্রিক নাম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠার তিনি আহ্বান জানান।
এছাড়াও বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট চিকিৎসক ও সমাজকর্মী ডাঃ মুস্তাফা আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন দেশ ও সমাজের উপর কোনও মারাত্মক আক্রমণ যখনই নেমে এসেছে এর বিরুদ্ধে ছাত্র শক্তি মাথা উঁচু করে লড়াই করেছে। তিনি রবীন্দ্রনাথ,  নজরুল ইসলাম সহ মনীষীদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে তারা সর্বদাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তিনি বলেন, ছাত্ররা অসীম সাহস নিয়ে লড়াই করে একদিকে পুরো দেশ তথা সমাজকে জাগিয়েছে ও শাসককে ছাত্র ও জনগণের ন্যায্য দাবি মানতে বাধ্য করেছে। আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও বরাক উপত্যকার মাতৃভাষা আন্দোলন এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি বলেন, ছাত্রছাত্রীদের কাছে সময়ের আহ্বান এসেছে সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধি নিয়ে করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ও বরাক উপত্যকার জনগণের উপর বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার।

নাম পরিবর্তন : শ্রীভূমিতে ছাত্র অবস্থান

ছাত্র সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক প্রজ্জ্বল দেব বলেন, অসম সরকার গত ১৯ নভেম্বর, ২০২৪ তারিখে কেবিনেট মিটিংয়ে সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধি নিয়ে করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করে। রাজ্য সরকার করিমগঞ্জ জেলার জনসাধারণের মতামতকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে, ছাত্র-শিক্ষক সংগঠন, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক, সামাজিক -সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে আলাপ আলোচনা না করে সমস্ত ধরণের গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে ভূলুণ্ঠিত করে  জেলার নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন এটা করতে গিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বাধীনোত্তর কালের বহু ছাত্র ও গণ আন্দোলনের ঐতিহ্যমন্ডিত করিমগঞ্জ জেলার ঐতিহাসিক ভূমিকাকে অস্বীকার করা হয়েছে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, বিপিন চন্দ্র পাল সহ প্রখ্যাত ব্যক্তিরা এই ঐতিহাসিক স্থানে এসেছিলেন। এইসব মহান ব্যক্তিরা সর্বদাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকা পালন করেছিলেন। অথচ সরকার  এদের অসাম্প্রদায়িক এবং সমন্বয়ের চিন্তাকে পায়ে মাড়িয়ে এই অন্যায় সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তিকে বিকৃত করে এই মহান ব্যক্তিত্বের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করেছে। কিন্তু সবাই অবগত যে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা প্রশাসনিক সুবিধার কথা বলে সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধি নিয়ে যখন বঙ্গ দেশকে বিভক্ত করেছিল এর বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দেশাত্মবোধক সঙ্গীত, কবিতার মধ্যে দিয়ে বাংলার জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ও দেশাত্মবোধ জাগ্রত করতে অসাধারণ ভূমিকা তিনি পালন করেছিলেন এবং দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে ঐতিহাসিক ভূমিকাও পালন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়াও বিশিষ্ট সংগ্ৰামী ব্যক্তিদের ও জনগণের দুর্দমনীয় সংগ্ৰামের কাছে নতি স্বীকার করেই বৃটিশ সরকার বঙ্গ বিভাজনের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল। তিনি সবাইকে সরকারের এই দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের সঙ্গে এই অঞ্চলের পরিকাঠামোগত ও জনজীবনের জীবন-জীবিকা সংক্রান্ত উন্নয়নের কোন সম্পর্ক নেই। অপ্রয়োজনীয় এবং অযৌক্তিক এই পরিবর্তন কার্যকরী করতে সরকারি কোষাগার থেকে বিশাল অর্থ ব্যয় হবে। তাছাড়া নথিপত্র পরিবর্তনে একদিকে যেমন জনসাধারণকে যথেষ্ট টাকা ব্যয় করতে হবে অন্যদিকে অভাবনীয় হয়রানির সম্মুখীন হতে হবে। তিনি বলেন স্বাধীনতার পর থেকেই উগ্ৰপ্রাদেশিকতাবাদী শক্তির বারংবার আক্রমণের শিকার হয়েছেন বরাক উপত্যকার জনগণ। ভোটার তালিকা সংশোধন, ডি ভোটার, ডিটেনশন কেম্প, এন আর সি নবায়ন সহ বিভিন্ন ধরনের  চক্রান্তে বরাক উপত্যকার জনগণ বারবার হেনস্থা হয়েছেন। তাই এমতাবস্থায় উগ্ৰপ্রাদেশিকতাবাদীদের মদতপুষ্ট সরকারের বরাক উপত্যকার ওপর সীমাহীন বৈষম্যে ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে একদিকে ঐক্যবদ্ধ তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে ও সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধি নিয়ে করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে এগিয়ে আসার জন্য রাজ্য সরকারকে বাধ্য করার জন্য তীব্র গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে সবাইকে আহ্বান জানান। ছাত্র অবস্থান থেকে আগামী দিনে তীব্র ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার সংকল্প গ্ৰহণ করা হয়।

Author

Spread the News