কাঁটাতারের ওপারে মা দুর্গার পূজা, মানিকপুরের সীমান্তের উৎসবের ছোঁয়া
মোহাম্মদ জনি, শ্রীভূমি।
বরাক তরঙ্গ, ১৬ সেপ্টেম্বর : কাঁটাতারের ওপারে প্রতিবছর ফুটে ওঠে অদ্ভুত এক আনন্দের উৎসব—মা দুর্গার পূজা। দেশ ভাগের পরও সীমান্তের বাধা, বিএসএফের কঠোর পাহারা, আর কাঁটাতারের বেড়া মানিকপুরবাসীর ভক্তি কমাতে পারেনি। ভারত-বাংলা সীমান্তের ঠিক ওপারে দাঁড়িয়ে, এই ছোট্ট গ্রামে প্রতিটি বছর হয় আনন্দ, ভক্তি এবং ঐতিহ্যের এক অপূর্ব মিলনমেলা। মানিকপুরের দুর্গাবাড়ির প্রতিটি পদক্ষেপে ছড়িয়ে আছে ২০০ বছরের ইতিহাস, মানুষের আবেগ, আর সীমান্ত জওয়ানদের সাথে এক অনন্য একাত্মতার গল্প।
যোগ যোগ ধরে ভারত – বাংলা সীমান্তের ভিতরেও বাজে দুর্গাপূজার আনন্দ।শ্রীভূমি জেলার “নো ম্যান্স ল্যান্ডে মানিকপুর কাঁটাতারের সীমানায় উৎসবের ছোঁয়া উদযাপিত মা দুর্গার পূজা। নো ম্যান্স ল্যান্ডের মধ্যে পূজিত হন মা দুর্গা।সীমান্তের জওয়ানদের পাহারায় প্রতিবছরের মতো এবারও উৎসবের আয়োজন কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে, সীমান্তের অগোচর রূপে, ভারত বাংলার মানিকপুর গ্রামে প্রতিবছরই সাজানো হয় এক বিশেষ দুর্গাপূজা। এখানে উৎসবের মরসুম মানেই গ্রামের মানুষের আবেগ, ভক্তি এবং আনন্দের এক অপরূপ ছোঁয়া।
অখণ্ড ভারতের সময়, মানিকপুরের দুর্গাপূজা ছিল গ্রামের সব মানুষের মিলনমেলা। চাঁদা দিয়ে আয়োজন হতো মন্দিরের, আর সবার হাতে ছিল পূজার আনন্দ ভাগাভাগি করার আনন্দ। তবে দেশ ভাগের পর, বাংলার বিভাজন এবং সীমান্তের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এই ঐতিহ্যকে কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিল। বিএসএফ এবং বিজিবি পাহারা দিতে শুরু করেছিল। কিন্তু সেই কড়া নিরাপত্তা, কাঁটাতারের বেড়া—কিছুই মানিকপুরবাসীর উৎসাহকে ম্লান করতে পারেনি।
আজও, ভারত-বাংলা সীমান্তের ঠিক ওপারে, মানিকপুরের দশভূজা দুর্গা মন্দিরে উদযাপিত হয় দুর্গাপূজা। মন্দিরের পাশে বিএসএফ জওয়ানদের ছাউনিও অবস্থান করছে। কাঁটাতার পেরিয়ে, সীমান্তের বেড়া পেরিয়ে, গ্রামের মানুষ অম্লান ভক্তি আর আনন্দের সঙ্গে মা দুর্গার আরাধনা করেন।
মানিকপুর দুর্গাবাড়ির এবারের পূজা কমিটির দায়িত্বে আছেন: সভাপতি পরিমল মালাকার, সম্পাদক চম্পক মালাকার, সহ-সম্পাদক অশোক দাস, কোষাধ্যক্ষ অর্পণ মালাকার, সহ-কোষাধ্যক্ষ অরিজিৎ মালাকার এবং সাংঘটনিক সম্পাদক অসিত দাস। বাজেট সীমিত হলেও, প্রত্যেকের সামর্থ্য অনুযায়ী তারা পূজার আয়োজন করেন। আর্থিক সংকট থাকলেও আনন্দের কোনো ঘাটতি হয় না। মন্দিরের সামনেই প্যান্ডেল তৈরি হচ্ছে, এবং প্রতিবছরের মতো এবারও জেলা সদর থেকে প্রতিমা আনা হবে।
কমিটির সভাপতি অপু মালাকার বলেন, যদিও আলোর ঝলকানি আমাদের এখানে সীমিত, তবু পূজার সাত্বিকতা ও ভক্তির প্রাধান্য আমরা সবসময় রাখি। ভারতের সীমান্তে হওয়ায়, দেশের সুরক্ষার স্বার্থে বিএসএফের নিয়ম মেনে আমাদের উৎসব আয়োজন করতে হয়। তাই সন্ধ্যা আরতি এবং বিসর্জন দিনের আলোতেই সম্পন্ন হয়।
গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা জানান, মানিকপুরের মন্দির শুধুমাত্র পূজার কেন্দ্র নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক প্রতীক। কাঁটাতারের ভিতরে অবস্থিত হওয়ায় এর গুরুত্ব দ্বিগুণ। দেশ ভাগের পর সীমান্তে বেড়া দেওয়া হয়েছে। তবু, আমাদের পুজোর আনন্দ কমে যায়নি। এখন গ্রামে আরও কয়েকটি দুর্গাপূজা হলেও, এই প্রাচীন পুজার আনন্দ আলাদা। সবাই এখানে আসে ছোট-বড়, নারী-পুরুষ মায়ের আশীর্বাদ নিতে,” তারা বলেন।
পুজার দিনগুলোতে, গ্রামের মানুষদের আনন্দে অংশ নেন সীমান্তের বিএসএফ জওয়ানরাও। তারা মণ্ডপে এসে উৎসবে মেতে ওঠেন, অঞ্জলি দেন, প্রসাদ বিতরণে সাহায্য করেন। এমনকি সীমান্ত সড়কের উপর দিয়ে ভাসান ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়, যা গ্রামের আনন্দকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
সীমান্তের দায়িত্বে থাকা বিএসএফের এক কর্মকর্তা জানান, “যেহেতু মানিকপুরের মন্দির ভারতের বাংলার সীমান্তে অবস্থিত, তাই আমরা নিরাপত্তার দায়িত্বে আছি। পুজার সময় কোনও ধরনের অসুবিধা না হয় সেজন্য সব ধরনের সহযোগিতা থাকবে। অতিরিক্তভাবে জওয়ান মোতায়েন করা হবে। সীমান্তে দায়িত্ব পালন করলেও, আমরা আনন্দের সঙ্গে এই উৎসব উপভোগ করি।
প্রতি বছরের মতো এবারও মানিকপুরে দুর্গাপূজা হবে ভক্তি, ঐতিহ্য, আনন্দ আর সীমান্তে বন্ধুত্বের এক অনন্য মিলনমেলা। দেশ ভাগ, সীমান্ত নিরাপত্তা, আর বাজেট সীমাবদ্ধতা এই সব বাধা সত্ত্বেও মানিকপুরবাসীর মায়ের প্রতি ভক্তি অটুট। কাঁটাতারের পেরিয়ে মা দুর্গার আরাধনায় মিলবে সেই চিরচেনা আনন্দ, যা বছর বছরের মতো এখানে নতুন প্রাণ ঢেলে দেবে।
মানিকপুর দুর্গাবাড়ি শুধু মন্দির নয়, এটি সীমান্তবর্তী মানুষের ঐতিহ্য, সাহসিকতা এবং অটুট ভক্তির এক প্রতীক যেখানে সীমান্তের ওপারেও মায়ের পুজো প্রতিটি হৃদয়কে একত্রিত করে।