আট বছর ধরে নিঃস্বার্থে মানসিক রোগীদের সেবা শুশ্রূষা করছেন মবজিল
আশু চৌধুরী, শিলচর।
বরাক তরঙ্গ, ১০ অক্টোবর : আট বছর ধরে নিজের টাকা খরচ করে মানসিক রোগীদের দেখভাল করে যাচ্ছেন সমাজকর্মী মবজিল হোসেন বড়ভূইয়া। এক বা দুইজন নয় বর্তমানে ৩৫ জন মানসিক রোগীর খাবার থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু খরস বহন করে চলেছেন তিনি। কেন মানসিক রোগীদের শুশ্রূষা, কেন বা আশ্রয়স্থল করলেন আজ বিশ্ব মানসিক রোগী দিবসে এক সাক্ষাৎকার বিস্তারিত তুলে ধরেন বড়ভূইয়া। ২০১৮ সাল থেকে চলছে সোনাইয়ের সৈদপুরে প্যারাডাইস এনজিও-র তত্বাবধানে সাফি মানসিক রোগীর আবাস। আর প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটের দায়িত্বে তিনি নিজে।

মবজিল হোসেন বড়ভূইয়া দীর্ঘ বছর ধরে হাইলাকান্দি রোডে মেডিক্যাল সংলগ্ন এলাকায় বসবাস করে আসছেন। একদিন বর্ষাকালে তিনি নিজের ব্যক্তিগত বাহনে শহর থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। সে সময় মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল এক কথায় গাড়ির আবের সামনে স্পষ্ট কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। ওই সময়ে একজন মহিলা মানসিক রোগী ভারি বৃষ্টির মধ্যে সড়কের পাশে রয়েছেন। এই করুণ দৃশ্যটি দেখে মনজিলের বিবেক ও হৃদয়ে নাড়া দেয়। তিনি বাড়িতে আর যাননি। মহিলাকে কীভাবে রক্ষা করবেন বা কোথায় আশ্রয় দেবেন এই বিষয়টি তার মাথায় খেলতে শুরু করে। তিনি গাড়ি থেকে নেমে মহিলাকে তাঁর ঘরে নিতে চাইলে কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী আপত্তি করে জানান এভাবে নিতে পারবেন না আইনি প্যাঁচে পড়ে যাবেন। কিন্তু মবজিলের বিবেক এবং হৃদয়ে সেই বিষয়টি মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলে। সহজে তিনি মেনে নিতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত পুলিশের সহযোগিতায় ওই মহিলাকে ঘরে তুলে নেন। ভর্তি করান শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সেখানে কয়েকদিন চিকিৎসার পর মেডিক্যালের রেফার নিয়ে তেজপুর মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যান। তিন মাস পর ওই মহিলা সুস্থ হয়ে তেজপুর থেকে ফিরে আসেন। আর সেখান থেকেই তাঁর এই মানবিক কাজ শুরু হয়। সালটা ছিল ২০১৭।

তিনি সৈদপুর প্রথম খণ্ড এলাকায় জমি ক্রয় করে মানসিক রোগীদের জন্য একটি আবাস তৈরি করেন। বরাক উপত্যকার বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মানসিক রোগীদের সেবা শুশ্রূষা, চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন মবজিল। প্রায় ৬৫ জন রোগী তার আবাসে ছিলেন। বর্তমানে মহিলা ও পুরুষ মিলে রয়েছেন ৩২ জন। কথা প্রসঙ্গে মবজিল বড়ভূইয়া জানান, নিয়মিত একজন চিকিৎসকের জন্য তিনি শিলচর যুগ্ম সঞ্চালক কার্যালয়ে আবেদন করেছিলেন কিন্তু কোন ধরনের সাড়া না পেয়ে তিনি আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। আদালতের রায়ে মাসে একজন চিকিৎসক এবং বিনামূল্যে ওষুধ পান। তবে কোন ধরনের সরকারি অনুদান আজ পর্যন্ত পাননি বলে আক্ষেপ করেন। সরকারি আধিকারিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা বার কয়েক আবাসটি পরিদর্শন করেছেন বটেই তবে সরকারি কোন সহযোগিতা পাননি। তিনি জানান, এই আবাসটি পরিচালনা করতে মাসে প্রায় লক্ষ টাকা খরচ হয়। রোগীদের দেখাশোনার জন্য দশ জন লোক সেখানে কর্মরত রয়েছেন। রয়েছেন দুইজন নার্সও। খাবারে কথাও তিনি উল্লেখ করে বলেন, সাধারণ মানুষের যতটুকু প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশি খরচ হয় সেখানে।
মবজিল বড়ভূইয়া জানান, সুস্থ হয়ে ৩০ জন ইতিমধ্যে তাদের পরিবারে পৌঁছেছেন। এর মধ্যে তিনজন মারা গিয়েছিলেন পুলিশ এবং সরকারি নিয়ম মতে মেডিক্যাল মর্গে রাখার পর যার যার ধর্মীয় শাস্ত্রমতে শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। তিনি এক গর্ভবতী মহিলার কথা উল্লেখ করে বলেন, চিত্তরঞ্জন বসুর রোডের এএসটিসি কার্যালয়ে প্রাঙ্গণে এক গর্ভবতী মহিলা মানসিক রোগীকে স্থানীয়রা দেখতে পেয়ে তাদের খবর জানান। ওই মহিলাকে উদ্ধার করে তারা শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান। এবং একটি সন্তানও জন্ম দেন। চিকিৎসা পরিষেবার পর সুস্থ হয়ে উঠলে ওই মহিলার কথা মতে শনবিল এলাকায় তার বাপের বাড়িতে পৌঁছে পরিবারের কাছে সমঝে দেওয়া হয়। সাক্ষাৎকারে এভাবে বেশ কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন তিনি। মবজিল হোসেন আহ্বান জানিয়ে বলেন, যদি কোন মানসিক রোগী রাস্তাঘাটে বা বাজারহাটে পড়ে থাকতে দেখতে পান তাহলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
আজ বিশ্ব মানসিক রোগী দিবসে তার আবাসে ছোট্ট একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। রোগীদের হাতে খাবার তুলে দেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এনজিও সভাপতি জসিম উদ্দিন লস্কর, হোসেন রাজা লস্কর, বাহারুল ইসলাম লস্কর, তাজউদ্দিন লস্কর প্রমুখ।