মানসিক স্বাস্থ্যর প্রয়োজনীয়তা

।। ববিতা বরা ।।
(উপ-পরিদর্শক, অসম পুলিশ)
৬ মার্চ : আপনি এখন কী করছেন বর্তমান? এটা বড় প্রশ্ন! সাধারণ প্রশ্ন, আমি কী করছি বা আপনি কী করছেন? দ্বিতীয় ব্যক্তির জন্য এটি এক সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন অনুসন্ধিৎসুমূলক প্রশ্ন, সাধারণ প্রশ্ন। কিন্তু প্রশ্নকর্তার প্রশ্ন উত্থাপন শৈলীর ওপরে এই সাধারণ প্রশ্নটিও হয়ে পড়ে কারও কারও জন্য বুকের ভেতর হুলের মতো বিধে যাওয়া যন্ত্রণা।

কি করিছো বা কি করছো, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে কিছু লোক অনিচ্ছুক। বলতে চায় না কারণ হয়তো তাঁরা কোনও কাজে নিযুক্ত হতে পারেনি বা নিযুক্ত হয়েও সুখী নয় বা অন্য কোনও কারণ। কিছু লোক আবার নিজেই ইচ্ছা করে পৃথিবীকে জানাতে ভালোবাসে যে তারা কি কাজ করছে এবং নিজেরাই চায় যেন অন্য কেউ তাদেরকে ‘কি করছো’ বলে প্রশ্ন করে।

বর্তমান সময়ে জীবনযাপনের জন্য কিছু একটা করাটা খুব প্রয়োজন। লাগলে ছোট থেকে ছোট কাজ হলেও। পকেটে নিজের উপার্জনের টাকা না থাকলে পৃথিবীর বিলাসিতা আপনি কিনতে পারবেন না।
এটাও ঠিক যে, কাজের কোনও ছোট বড় নেই। কাজ, কাজই। ব্যক্তি বিশেষে, ব্যক্তির যোগ্যতা বা দক্ষতার ভিত্তিতে কাজের মান আলাদা হয়।

কেউ কেউ যোগ্যতা থাকলেও পরিস্থিতির কারণে মন চাওয়া কাজে নিযুক্ত হতে পারে না, আবার কেউ কেউ পরিস্থিতির কারণেই এমন কিছু কাজে নিযুক্ত হয় যা তার মন চাওয়া কাজের সম্পূর্ণ বিপরীত। তবুও, আপনি কি কাজ করছেন বা অন্য কেউ কি কাজ করে খাচ্ছে — এটা কোনও হাসির বা উপহাসের বিষয় নয়।

একজন ব্যক্তি কোন পরিবেশে বড় হয়েছে বা কিভাবে শিক্ষা নিয়েছে বা তার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা কেমন— এই সবকিছুই কর্মক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।
কেউ কাজ করছে বা কেউ কাজ করছে না— এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু অন্যের পেশাকে সমালোচনা করা বা নিজের পেশা নিয়ে অহংকারী হওয়া সমাজের সবচেয়ে কুৎসিত ব্যক্তি। আজকের মানুষগুলো উপার্জন এবং লোভনীয় দিকটাতেই চোখ দেয় ঠিকই, কিন্তু সবকিছু একপাশে রেখে অন্য একটি দিকের দিকে তাকালে সেই দিকটিকে গুরুত্ব দিয়ে জীবনের মূল্যায়ন করার জন্য কেউ বের হয় তেমন শূন্য।

মানসিক সুখ? মানসিক স্বাস্থ্য? অন্যের দৈনন্দিন জীবনযাপনের সঙ্গে নিজের জীবনযাপনের তুলনায় ব্যাহ্যিক হিসেবনিকেশ করে আক্ষেপ বা সন্তুষ্টি পাওয়া ব্যক্তি কি কখনও মেপে দেখেছে মানসিক সুখের পরিমাণ? কথা এটা যে, আপনি কেমন আছেন। যা আপনাকে জিজ্ঞেস করতে বা বোঝার জন্য/বোঝাতে কোনো শ্রোতা আর প্রশ্নকর্তা নেই। Formalities এর কারণেই হোক, যখন কেউ ভালো আছো কি না বলে জিজ্ঞেস করে, সেই প্রশ্নকর্তা অচেনা ব্যক্তিকে ‘কি করছো’ বলে জিজ্ঞেস করা পরিচিত ব্যক্তির চেয়ে বেশি আপন লাগে। কমপক্ষে Formalities এর কারণেই হোক, কিছুক্ষণের জন্য হলেও আপনার খোঁজ নেওয়া একটা অস্তিত্ব। অবশ্যই তাতেও কেমন লাগে।

আপনার সুখের দিনে দেখবেন, কিছু ব্যক্তি ফড়িঙের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে আপনার সুখে সুখী হবে, ভার্চুয়ালি প্রকাশ করবে আপনার সুখের সুখ। অথচ সেই ব্যক্তিগুলোই আপনার দুঃখের সময়ে অদৃশ্য হয়ে প্রমাণ করে যে, আপনার সুখে এমন লোকেরা ভিতরে চেপে রাখা ঈর্ষার বনজুইয়ের কেমন বেশি যে প্রখর ছিল!

আপনার থেকে কোনও স্বার্থ আদায় করা পর্যন্ত আপনি একজন মধ্যম না হওয়া পর্যন্ত, আপনার দুঃখের দিনের গান শুনতে কোনও সঙ্গীত প্রেমী শ্রোতা আপনার কাছে আসবে না। আপনার আত্মীয়তা পেতে হলে হলেও আপনাকে নিজেকে বিক্রি করার মতো কোনও ব্যবসায়ী হতে হবে। মানুষ এতটাই বস্তুবাদী হয়ে পড়েছে যে, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন করাটা যেন ভুলেই গেছে। এভাবে একাংশ লোক মনে মনে ডিপ্রেশন, টেনশন, অ্যাংজাইটি বা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সুখ-দুঃখগুলো বয়ে বেড়ায়। কি হয়েছে বলে জিজ্ঞেস করতে আমরা একটা যন্ত্র। ঘরের মানুষই ঘরের মানুষের কথা বোঝে না, একসঙ্গে বসে কথাবার্তা বলার সময় নেই, অন্য কথায় আগ্রহ নেই।

মন থেকে একা হয়ে ঘুরে বেড়ানো ব্যক্তি নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে বা সামান্য কারও সঙ্গ খোঁজে দুইটা কথা বলার জন্য…কিন্তু কেউ নেই। ব্যস্ত নগরীতে কারও সময় হবে কি সামান্য বাস্তব পৃথিবী থেকে বেরিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে? ‘কত টাকা পাইছো’ বলে প্রশ্ন করার চেয়ে ‘তুমি সুখী আছো নাকি’ বলে একবার জিজ্ঞেস করতে?

Author

Spread the News