রসেন্দ্রকুমার দে-র সমীক্ষা গুচ্ছ ও স্মৃতিকথা
।। মিতা দাসপুরকায়স্থ।।
(লেখক)
২৭ ডিসেম্বর : ৮৭ বছর বয়সে চলে গেলেন গত ১৮ ডিসেম্বর শনিবার লেখক রসেন্দ্রকুমার দে। খাদ্যনালীতে দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তাঁর সারা জীবনের সঞ্চিত রাখা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা আমার কাছে নিয়ে আসেন গত বছর পুজোর পরেই পুস্তক আকারে প্রকাশ করার জন্য। আমি ক্রমান্বয়ে তাঁর লেখাগুলো সাজিয়ে পুস্তকাকার দিই তিনটি খণ্ডে। সমীক্ষা গুচ্ছ প্রথম খণ্ড, সমীক্ষা গুচ্ছ দ্বিতীয় খণ্ড ও সমীক্ষা গুচ্ছ তৃতীয় খণ্ড। নির্ভেজাল খাঁটি প্রকৃত ভদ্রলোক এই লেখক তাঁর প্রথম বই ১৫২ পাতার ”সমীক্ষা গুচ্ছ প্রথম খণ্ড’ পেয়ে অত্যন্ত খুশি হন। বলেন দ্বিতীয় খণ্ড করে দিতে। সেসময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। শিলচরে টেস্টে তাঁর ক্যান্সার ধরা পড়ে। বলেন– “সময় কমে আসছে, তাড়াতাড়ি করে দিন। আমি তো বইয়ের কাজ দেখতে পারবো না তেমন করে অসুস্থ শরীর নিয়ে। আপনি করে দিন।”
খুব দ্রুত মারণরোগ তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে অসহায় করে ফেলে। ১৫২ পাতার ‘সমীক্ষা গুচ্ছ দ্বিতীয় খণ্ড’-এর কাজ শেষ হয়। ২৭ জুলাই থেকে শিলচরে তিনদিনের ‘নতুন দিগন্ত প্রকাশনী’র অনুষ্ঠান ‘জ্যোতির্গময় পূর্ব দিগন্ত উৎসব’ আয়োজন করেছিলাম দেশের বিভিন্ন স্থানের অতিথি সমাগমে। রসেন্দ্রকুমার দে-র অনুমতি নিলাম তাঁর পুস্তক দু’টোর আনুষ্ঠানিক প্রকাশের জন্য। তিনি বললেন ‘আমি তো কিছু করতে পারবো না। উপস্থিত থাকতে পারবো কিনা বলতে পারছি না। শরীরের অবস্থার উপর নির্ভর করবে আমার আসা না আসা। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার। না পারলে আমার কন্যা যাবে। উদ্যোগ আপনাকে নিতে হবে। ‘খুব খুশি অনুষ্ঠান ও তাঁর বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হবে শুনে। ২৭ জুলাই বিকেলে ‘জ্যোতির্গময় পূর্ব দিগন্ত উৎসব’ এর মঞ্চে বরাক ও বহির্বরাকের নক্ষত্র-লেখক সমাবেশে রসেন্দ্রকুমার দে রচিত পুস্তক দু’টি ‘সমীক্ষা গুচ্ছ প্রথম খণ্ড’ ও ‘সমীক্ষা গুচ্ছ দ্বিতীয় খণ্ড’ আনুষ্ঠানিকভাবে পরপর প্রকাশিত হয়। বোর্ড বাইন্ডিং সুদৃশ্য অতিরিক্ত জামা পরা এই বই দু’টিতে আছে সময়োচিত সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ের উপর তাঁর সমীক্ষা, বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা ও মতামত আকারে প্রতিবেদন।
অনুষ্ঠানে শেষপর্যন্ত তিনি এসেছিলেন তাঁর সুপুত্রী সঙ্গীতশিল্পী নবনীতা দাসের সাহায্য নিয়ে।
এই পুস্তক দু’টির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান নবনীতা দাসের গান দিয়ে শুরু হয়। কলকাতার সুপরিচিত কবি লেখক স্বপন ভট্টাচার্য মঞ্চে উপস্থিত থেকে সমীক্ষা গুচ্ছ প্রথম খণ্ড ও দ্বিতীয় খণ্ড নিয়ে আলোচনা করেন। উপস্থিত ছিলেন মঞ্চে গুয়াহাটির যোগ বিষয়ক লেখক ধীরাজ নাথ প্রমুখ। লেখক রসেন্দ্র কুমার দে-ও বক্তব্য রাখেন। সেদিন তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। কাঁপছিলো তাঁর সারা শরীর। তাঁকে বসার ব্যবস্থা করে দিই। তবে তাঁর স্বপ্নপূরণের প্রতিফলন ছিল চোখে-মুখে। এক পরম প্রশান্তি ফুঁড়ে বেরোচ্ছিলো সেদিন তাঁর মুখমণ্ডল থেকে। একেই বোধহয় বলে আভিজাত্য। তৃপ্তিতে ভয়াবহ রোগ যন্ত্রণার মাঝেও আমার কাজকর্মের প্রতি সন্তোষ ব্যক্ত করেছেন বারবার।
এভাবে রসেন্দ্রকুমার দে-র মতো মানুষই আমার কাছে দেবতার স্বরূপ, তাঁদের রেখে যাওয়া ব্যবহারে ও কাজকর্মে। তাঁর মত মানুষদের আশীর্বাদেই আমি আমার চলার পথে অনুপ্রেরণা পাই আমার কাজকর্ম এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। তাঁর সঙ্গে দেখা হলে তাঁকে চলাচলে সাহায্য করতে চাইলে তিনি সবিনয়ে বুঝিয়ে দিতেন সাহায্য তিনি চান না। তিনি নিজে নিজেকে হাঁটাচলায় সহযোগিতা করতে পারবেন। যতদিন পেরেছেন চলেছেন কষ্ট করে হলেও নিজে নিজে শয্যাশায়ী হওয়ার আগে পর্যন্ত। মাঝে মাঝে ফোন করে খবর নিতাম –তিনি তাঁর চিরাচরিত অভ্যাস খুব আস্তে আস্তে তাঁর শারীরিক অবস্থা জানাতেন । তারপর একদিন ফোনে বললেন– চলে যাবেন মুম্বাই টাটা হাসপাতালে। এসে ‘সমীক্ষা গুচ্ছ তৃতীয় খণ্ড’ ফাইনাল করবেন, আমি যাতে কাজ শেষ করে রাখি।’ সমীক্ষা গুচ্ছ তৃতীয় খণ্ডে’র কাজ মোটামুটি শেষের পথে, তিনি ফিরে এলেন মুম্বাই থেকে দুমাস পরে। তখন তাঁর অবস্থা আরও খারাপ। ফোনে কথা বললে বোঝা যায় না তাঁর কথা। শোনা যায় না। তিনি শুনেন আমি শুধু বলে যাই। আর ‘নতুন দিগন্ত প্রকাশনী’র পক্ষ থেকে স্টাফ তাঁর ঘরে পাঠাই। এভাবেই আনা-নেওয়ায় তাঁর সঙ্গে প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডের কাজও করেছি।
যাই হোক সবকিছু রেডি করে শেষে উনাকে একবার ফাইনাল দেখিয়ে ‘সমীক্ষা গুচ্ছ তৃতীয় খণ্ড’ তাঁর হাতে তুলে দিলাম। তৃতীয় খণ্ডের মোড়ক উন্মোচন করালাম ‘নতুন দিগন্ত প্রকাশনী’র বিশ্বকর্মা পূজার অনুষ্ঠানে বরাক উপত্যকার কবি-লেখকদের উপস্থিতিতে। দুঃখের বিষয় তিনি সে সময় আর উপস্থিত থাকতে পারেননি। বলেছিলেন আমার কন্যা নবনীতা যাবে। তিনি এত অসুস্থ ছিলেন যে তাঁর কন্যা সঙ্গীতশিল্পী নবনীতা দাস ও জামাতা সুপরিচিত তবলাবাদক ভাস্কর দাসের পক্ষেও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা সম্ভব হয়নি। আমরাই উপস্থিত লেখকরা মিলে ‘নতুন দিগন্ত প্রকাশনী’র বিশ্বকর্মা পূজার অনুষ্ঠানে ১৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ‘সমীক্ষা গুচ্ছ তৃতীয় খণ্ড’ আনুষ্ঠানিক প্রকাশের ঘোষণা করলাম।
জীবনে শিলচরের প্রতিটা দৈনিকেই অনেক উত্তর সম্পাদকীয় ও চিঠিপত্র লিখেছেন রসেন্দ্রকুমার দে। আজ লেখক পূর্ত বিভাগ থেকে অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডিশনাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার রসেন্দ্রকুমার দে আমাদের মধ্যে নেই কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর স্বপ্নপুস্তক তিনটি ‘সমীক্ষা গুচ্ছ প্রথম খণ্ড’, “সমীক্ষা গুচ্ছ দ্বিতীয় খণ্ড’ ও ‘সমীক্ষা গুচ্ছ তৃতীয় খণ্ড’। আর তাঁর ব্যবহার বিনয় রয়ে গেছে আমাদের কাছে স্মৃতি হয়ে। লেখক রসেন্দ্রকুমার দে যেখানেই থাকুন তাঁর জন্য রইলো অসীম শ্রদ্ধা। তাঁর আত্মার সদ্গতি হোক। চিরশান্তি লাভ করুক। আমি ধন্য তাঁর স্বপ্ন পূরণে তাঁকে সাহায্য করতে পেরে। তাঁর এক স্বপ্নপূরণের মাধ্যম ও সঙ্গী হতে পেরে। ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি।