শহিদ অসিতরঞ্জনের আত্মবলিদান দিবসে গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠানের শ্রদ্ধাঞ্জলি

বরাক তরঙ্গ, ৩ জুলাই : স্বাধীনতাপূর্ব অসম অঞ্চলের প্রথম শহিদ অসিতরঞ্জন ভট্টাচার্যকে স্মরণ করল শিলচর গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠান। বুধবার অসিতরঞ্জন ভট্টাচার্যের আত্মবলিদান দিবসে শিলচর গান্ধী প্রতিষ্ঠান শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এ দিন বিকেল সাড়ে পাঁচটায় গান্ধীবাগে অবস্থিত শহিদের আবক্ষ প্রতিমূর্তিতে প্রথমেই পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করেন প্রতিষ্ঠানের সভাপতি শান্তনুকুমার দাস, উপদেষ্টা নীহারঞ্জন পাল, কার্যকরী সভাপতি শেখর পালচৌধুরী, সম্পাদক অশোক কুমার দেব সহ উপস্থিত সদস্য সদস্যাবৃন্দ।

এরপর গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় এক আলোচনা সভা। এতে বিভিন্ন বক্তা শহিদ অসিতরঞ্জন ভট্টাচার্যের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে শহিদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। শুরুতে অশোককুমার দেব বলেন, স্বাধীনতার আগে বৃহত্তর সিলেট  অঞ্চল আসামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৩৪ সালের ২ জুলাই সিলেট জেলে ভোর সাড়ে চারটায় মাত্র উনিশ বছর বয়সের বিপ্লবী অসিতরঞ্জনের ফাঁসি হয়। সেদিন সিলেট জেলে বন্দি ছিলেন অচিন্ত্যকুমার ভট্টাচার্যও। তিনি শহিদের ফাঁসির দৃশ্য দেখেছেন। তিনি নিজেও জেলের সকল বন্দিরা সে সময় “অসিত ভট্টাচার্য কি জয়”, “বন্দেমাতরম” প্রভৃতি শ্লোগান  দিয়ে চতুর্দিক কাঁপিয়ে তুলেন।

পীযূষ চক্রবর্তী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালিদের সবচেয়ে বেশি অবদানের কথা স্মরণ করে আবেগঘন হয়ে বলেন বিপ্লবী অসিতরঞ্জন ভট্টাচার্য সহ ৪১ জন বাঙালি তরুণ স্বাধীনতার জন্য ভারতের বিভিন্ন জেলে ফাঁসিতে শহিদ হয়েছেন। এছাড়া আরও কত বাঙালি সন্তান যে ব্রিটিশের গুলিতে শহিদত্ব বরণ করেছেন তার ইয়ত্তা নেই।

প্রবীর কুমার রায়চৌধুরী শিলচরে শহিদ অসিতরঞ্জন ভট্টাচার্যের আবক্ষ মূর্তি প্রতিষ্ঠার পশ্চাৎপঠ তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানের মুখ্যবক্তা নীহাররঞ্জন পাল বলেন শহিদ অসিতরঞ্জন ভট্টাচার্যের পিতৃনিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া (পূর্বতন কুমিল্লা) জেলার কসবা উপজেলার লেসিয়ারা গ্রাম। কিন্তু তাঁর মামার বাড়ি ছিল হবিগঞ্জ (সিলেট) জেলার মাধবপুর উপজেলার বেজুড়া গ্রামে।১৯১৫ সালের ৪ এপ্রিল অসিত জন্মগ্রহণ করেন মামার বাড়িতে।তাঁর পিতার নাম ছিল ক্ষীরোদমোহন ভট্টাচার্য ও মাতা বিরজা সুন্দরী দেবী। ছোটোবেলাতেই অসিত বিপ্লবী অনুশীলন সমিতিতে যোগ দেন।অসিতের দাদা বিধুভূষণ ভট্টাচার্যও ছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেনের দলের সদস্য। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহে অংশ নেন তিনি।এরপর ২২ এপ্রিল চট্টগ্রামের উপকণ্ঠে জালালাবাদ পাহাড়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের সঙ্গে প্রতক্ষ যুদ্ধে শহিদের মৃত্যুবরণ করেন বিধুভূষণ। দাদার আত্মদানে অসিত আরও বেশি করে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংকল্পবদ্ধ হন।

অসিতদের বাবা ক্ষীরোদ মোহন ভট্টাচার্য করিমগঞ্জ এওলাবাড়ি চা বাগানের সামান্য বেতনের চাকুরি করতেন। দারিদ্র্য নিয়েই অসিত পড়াশোনা করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হন।সে সময়ই ১৯৩৩ সালের ১৩ মার্চ  সংগঠনের নির্দেশে বিপ্লব কার্য পরিচালায় টাকার প্রয়োজনে অসিতের নেতৃত্বে ছয়জন বিপ্লবীর দল হবিগঞ্জের ইটাখোলা স্টেশনে শিলচর থেকে চাঁদপুরগামী সুরমা মেলের মেলব্যাগ লুঠ করেন। পালিয়ে যেতে আহত অসিত সহ চার জন বিপ্লবী ধরা পড়েন। বাকি তিন জন ছিলেন বিরাজ মোহন দেব,বিদ্যাধর সাহা ও গৌরাঙ্গলাল দাস।মহেশ রায় ও মনমোহন সাহা পালিয়ে যেতে সমর্থ হন।দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে ১৯৩৪ সালের ৪ জুলাই সিলেট জেলে ফাঁসি হয় অসিতরঞ্জন ভট্টাচার্যের। দীপ্ত পদক্ষেপে “স্বাধীন ভারত কি জয়” শ্লোগান দিয়ে নির্ভীকভাবে ফাঁসিমঞ্চে চড়ে শহিদত্ব বরণ করেন ১৯ বছরের বিপ্লবী।তাঁর শবদেহ পরিবারের হাতে সমঝে দেওয়া হয়নি। পুলিশের হেফাজতে সিলেট সাগর দিঘির পারে শ্মশানঘাটে শবদেহ দাহ করা হয়।তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা প্রমোদ রঞ্জন ভট্টাচার্য ছাড়া আর কাউকে দাহের সময় উপস্থিত থাকতে দেওয়া হয়নি।অসিতের সঙ্গী অপর তিন জন বিপ্লবীকে যাবজ্জীবন দীপান্তর দণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

নীহারবাবু তাঁর মূল্যবান বক্তব্যে স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশে সাড়া জাগানো আরও কয়েকটি ডাকলুঠ মামলার ইতিহাসও তুলে ধরেন।১৯২৫ সালের ৯ আগস্ট উত্তরপ্রদেশের কাকোরিতে দশজন বিপ্লবী ট্রেন থামিয়ে সরকারি ডাকের দশহাজার টাকা লুঠ করলে সারা দেশে সাড়া পড়ে যায়।ইতিহাসে এই ঘটনা সম্পর্কিত মামলাকে কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা বলে অবিহিত করা হয়।এই মামলায় চারজন বিপ্লবীর ফাঁসি হয়েছিল।এরমধ্যেও একজন ছিলেন বাঙালি। তিনি হলেন শহিদ রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ী। ১৯২৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর উত্তরপ্রদেশের গোণ্ডা জেলে তাঁর ফাঁসি হয়।অপর তিন বিপ্লবীকে ১৯ ডিসেম্বর একই দিনে উত্তরপ্রদেশের ভিন্ন ভিন্ন জেলে ফাঁসি দেওয়া হয়।শহিদ পণ্ডিত রামপ্রসাদ বিসমিলকে গোরখপুর জেলে,শহিদ আসফাক উল্লা খাঁ- কে ফৈজাবাদ জেলে এবং শহিদ ঠাকুর রোশন সিংকে এলাহাবাদের (প্রয়াগরাজের) মালাকা জেলে ফাঁসি দেওয়া হয়।
নীহারবাবু আরও বলেন শহিদ অসিতরঞ্জন কিংবা ক্ষুদিরামদের স্মরণ করা শুধু কোনও ব্যক্তি বা সেই শহিদকেই স্মরণ করা নয়।এদের স্মরণে একটা যুগকে স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানো হয়।তিনি স্বাধীনতার অগ্নিযুগের সকল শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বক্তব্য শেষ করেন।

অতনু চৌধুরী শহিদের মূর্তির পরিসর সংস্কারের প্রস্তাব রাখেন।আলোচনায় প্রাসঙ্গিক বক্তব্য রাখেন নাগরিক স্বার্থ রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সম্পাদক হরিদাস দত্ত,  কার্যকরী সভাপতি আইনজীবী শেখর পালচৌধুরী সর্বোদয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা অনিতা বসু প্রমুখ। সভাপতি শান্তনু কুমার দাসের বক্তব্যের পর  অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

Author

Spread the News