বরাকের শিল্পজগতে ইন্দ্রপতন, চিরনিদ্রায় স্বপ্নেশ চৌধুরী

বরাক তরঙ্গ, ২৩ মে : বরাককে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তিনি। সুদূর আন্দামানের শিল্পের বিকাশেও তাঁর অসামান্য অবদান। তাঁরই পরিশ্রমে আজ তীর্থক্ষেত্র সেলুলার। কলকাতার সমকালীন শিল্পেও ছিল সম্মানজনক স্থান। কিন্তু কালের নিয়মে এবার থেমে গেল দীর্ঘ সৃজনযাত্রা। স্বপ্নলোকে পাড়ি দিলেন বরাক মূলের কৃতী শিল্পী স্বপ্নেশ চৌধুরী। বৃহস্পতিবার সকালে কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতালে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। রেখে গেছেন  এক ছেলে ও এক মেয়ে সহ অসংখ্য গুণমুগ্ধকে।

স্বপ্নেশ চৌধুরী- সমকালীন ভারতীয় শিল্প জগতে অনেকের কাছেই এক সম্মানজনক নাম। জন্ম ১৯৪৪ সালে সিলেটের মৌলভী বাজারে। ছোটবেলাতেই চলে আসেন শিলচরে। বাবা সুবোধচন্দ্র চৌধুরী এবং মা শান্তিলতা। বাবা যেহেতু শিলচর ডাক বিভাগে চাকরি করতেন সেই সুবাদে স্বপ্নেশরা বসতি গড়েছিলেন আর্যপট্টিতে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা শিলচর সরকারি বালক বিদ্যালয়ে। এরপর শিল্প শিক্ষা নিতে পাড়ি জমান কলকাতার উদ্দেশ্যে।

তবে সেদিনের শিল্পের যাত্রাপথ মোটেই মসৃণ ছিল না। পঞ্চাশ-ষাটের শিলচরের শিল্পচর্চা ছিল শুধুই সৌখিনতার নামান্তর। ক্যারিয়ার গড়ার চিন্তা তো নিছক পাগলামির শামিল। তবে এ অঞ্চলের সরস্বতী পূজা, নাটকের চর্চাকে ঘিরে সৃষ্টিশীল কাজ কর্ম অনেকেই আকর্ষিত করেছিল। সঙ্গে বীরেন্দ্র লাল ভৌমিকের ড্রইংয়ের বই আর কলকাতা থেকে আসা ম্যাগাজিনের অলংকরণ সৃজন উৎসাহে ইন্ধন যুগিয়েছিল। এমন তিন সৃজনশীল দামালের নাম হচ্ছে সুষেণ ঘোষ, শুচিব্রত দেব এবং তাদের দু-তিন বছর ছোট সঙ্গী স্বপ্নেশ চৌধুরী।

বরাকের শিল্পজগতে ইন্দ্রপতন, চিরনিদ্রায় স্বপ্নেশ চৌধুরী

১৯৫৯ সালে তদানীন্তন আসাম সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে কলাভবনে ভর্তি হয়েছিলেন শুচিব্রত এবং সুষেণ। অনিশ্চিত লক্ষ্যে ঝাঁপ ছিলেন স্বপ্নেশও। ১৯৬০ সালে চলে গেলেন কলকাতা। ১৯৬২ সালে ভর্তি হলেন কলকাতার গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট-এ। এরপর ১৯৬৭ পর্যন্ত চলল এক শিল্প শিক্ষানবিশের মরিয়া প্রয়াস। একজন মেধাবি ছাত্রের স্বীকৃতি সহ ডিগ্রি নিয়ে বেরোলেন স্বপ্নেশ চৌধুরী।

নকশাল আন্দোলনের তীব্রতায় অস্থির বাংলায় চলল জীবন জীবিকার কষ্টকর সংগ্রাম। আনন্দবাজার পত্রিকায় নিয়মিত অলংকরণ সহ ফ্রিল্যান্স আর্টিস্ট হিসেবেও কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৭০ সালে আন্দামান সরকারের শিক্ষা বিভাগে শিল্প শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু সেখানে তিনি একজন চাকরিজীবী হয়ে না থেকে আন্দামানে শিল্পের প্রসারে মনোনিবেশ করেন। গড়ে তুললেন আন্দামান আর্টিস্ট সার্কল। তার ছবিতে ধরা পড়লো আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের সৈকত, দুর্গম বনানী, সামুদ্রিক সম্পদ, রঙিন পাখি, মাছ। দেশের মূল স্রোতের শিল্পে আত্মপ্রকাশ করল এক অনন্য আন্দামান। সম্পাদক হিসেবে আর্টিস্ট সার্কলের প্রদর্শনী দেশের বড় বড় শহরে করলেন তিনি। বহু শিল্পী তৈরি করলেন।

বরাকের শিল্পজগতে ইন্দ্রপতন, চিরনিদ্রায় স্বপ্নেশ চৌধুরী

যদিও আন্দামান পাড়ি দেবার আগে বরাকের শিল্পের বিকাশের স্বার্থে শিল্পী মুকুন্দ দেবনাথ এবং ধীরেশ পালের সঙ্গে মিলে ১৯৬৯ সালে গড়ে তুলেছিলেন কাছাড় শিল্পী সংস্থা। তাদের উদ্যোগে ওই সংস্থার মাধ্যমে প্রথম শিল্পের পাঠদান শুরু হয়েছিল এ অঞ্চলে যা বরাকের শিল্প ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পরবর্তীতে আন্দামান চলে গেলেও এ অঞ্চলে শিল্পক্ষেত্রে আলোর দিশারি মুকুন্দ দেবনাথের সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ বজায় রাখতেন স্বপ্নেশ। তাছাড়া মুকুন্দ দেবনাথের উদ্যোগে এবং তার সৃষ্ট ফাইন আর্টস অ্যাকাডেমির ব্যবস্থাপনায় ১৯৮২ সালে শিলচর গান্ধী ভবনে স্বপ্নেশের ছবির একক প্রদর্শনীও হয়। পাশাপাশি, উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে মুকুন্দ দেবনাথের ফাইন আর্টস অ্যাকাডেমি গড়ার পিছনে একজন নেপথ্য সহযোদ্ধার ভূমিকাও পালন করেছিলেন স্বপ্নেশ।

তবে স্বপ্নেশের জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে সেলুলার জেলকে জাতীয় সৌধ হিসেবে সার্থক রূপায়ণের বিষয়টি। ১৯৭৯ সালে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই সেলুলার জেলকে জাতীয় স্মারক হিসেবে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। জাতীয় স্মারক ঘোষিত হওয়ার পর তার অধিকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হন স্বপ্নেশ চৌধুরী। এরপর স্বপ্নেশ যা করলেন তা এক ইতিহাস। অক্লান্ত পরিশ্রম, নিষ্ঠা এবং সৃজন মাধুরী মিশিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মৃতি মন্দিরকে সুসজ্জিত এবং সমৃদ্ধ জাতীয় সংগ্রহশালায় রূপান্তরিত করেন তিনি। নিরলস প্রয়াসে লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকে তিনি ১৮৮০ সালের পর থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত দুর্লভ সব ছবি এনে সেলুলার জেলে একটা দর্শনীয় গ্যালারি তৈরী করতে সমর্থ হন। দিল্লির ন্যাশনাল আর্কাইভ থেকে ব্রিটিশ শাসনের সময়কালের বহু গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট, মাইক্রোফিল্ম সংগ্রহ করে সেলুলার জেলের আর্কাইভকে সমৃদ্ধ করেন। এশিয়াটিক সোসাইটি ও কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগার থেকে গবেষকদের সহায়ক এক মূল্যবান গ্রন্থাগার স্থাপিত করেন। আজ স্বপ্নেশের স্বপ্ন মেখে সেলুলার জেল জাতীয় স্মারক বিশ্বভর পর্যটকদের কাছে বিরাট আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। তাছাড়া প্রত্যেক বছর প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লিতে আন্দামানের ট্যাবলোর পরিকল্পনা, প্রতিবছর নভেম্বরে দিল্লির প্রগতি ময়দানে অনুষ্ঠিত জাতীয় প্রদর্শনীতে মণ্ডপ সজ্জার মুখ্য দায়িত্ব শিল্প নির্দেশক স্বপ্নেশ সুচারুভাবে পালন করেছেন। আন্দামানে সরকারি, বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ সব অনুষ্ঠানেই শিল্প সজ্জার কাজ করেছেন স্বপ্নেশ বছরের পর বছর। কত বইয়ের অলঙ্করণ করেছেন তার হিসেব পাওয়া মুশকিল। ১৯৮৪ সালে রাষ্ট্রপতি জৈল সিং স্বপ্নেশকে জাতীয় শিক্ষক হিসেবে রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করেন।

বরাকের শিল্পজগতে ইন্দ্রপতন, চিরনিদ্রায় স্বপ্নেশ চৌধুরী

আন্দামানে সব ভালোই চলছিল। পেয়েছিলেন প্রতিষ্ঠা, অগাধ সম্মান এবং কাজ করার অবাধ স্বাধীনতা। কিন্তু ২০০৪ এর ২৬ ডিসেম্বরের সুনামি তার জীবনের সবকিছু তছনছ করে দেয়। সুনামি দৈত্যাকার রূপ নিয়ে আছড়ে পড়েছিল আন্দামান সহ উপকূলবর্তী অঞ্চলে। পোর্টব্লেয়ারের বিদ্যুৎ, টেলি যোগাযোগ, জল সরবরাহ সব বন্ধ হয়ে গেল। প্রচণ্ড অসুস্থ স্ত্রীকে অর্ধচেতন অবস্থায় দু’হাতে কোলে তোলে কোনরকমে নার্সিংহোমে পৌঁছলেও বাঁচাতে পারেননি স্বপ্নেশ। প্রায় বিনা চিকিৎসায় কোলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন শিল্পী জীবনের দীর্ঘ সংগ্রামের সাথী গায়ত্রী।  এবার এক দুঃসহ বেদনা নিয়ে আন্দামান ছাড়লেন স্বপ্নেশ। এসে নতুন করে বসতি স্থাপন করলেন কলকাতার নাকতলায় ছেলে-মেয়েকে নিয়ে। কলকাতায় এসেও স্ত্রীকে হারানোর ব্যথা কাটিয়ে মৃতপ্রায় ক্যানভাস আর্টিস্ট সার্কলকে পুনরুজ্জীবনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। নিজেও চুটিয়ে কাজ চালিয়ে যান এবং প্রদর্শনীও করেন। পাশে পেয়ে যান পুরনো শিল্পী বন্ধু শুচিব্রত দেবকেও। নিজের সৃজনী, নিষ্ঠা এবং ব্যতিক্রমী চিত্র রচনার জন্য সব মহলেই জায়গা করে নেন স্বপ্নেশ। পশ্চিমবঙ্গের অভিজাত ‘একাডেমী অব ফাইন আর্টস’র তিনি সভাপতি পদের দায়িত্ব নির্বাহ করেন। এ বছর পয়লা বৈশাখ ‘বাংলা দিবস’ উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে ‘অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরস্কারে’ সম্মানিত করে। কিন্তু ইতিমধ্যে বয়স আস্তে আস্তে কাবু করে নিয়েছিল। ক বছর থেকেই অসুস্থতা নিত্যসঙ্গী ছিল। কিডনিজনিত অসুখেও ভুগছিলেন। একবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছিল।

বরাকের শিল্পজগতে ইন্দ্রপতন, চিরনিদ্রায় স্বপ্নেশ চৌধুরী

বুধবার হঠাৎ করে ফের অসুস্থ বোধ করলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে শেষ রক্ষা হয়নি বৃহস্পতিবার সকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে কলকাতার শিল্পী মহলের অনেকেই গভীর শোক ব্যক্ত করেছেন। শোক ছেয়েছে বরাকেও। শোক ব্যক্ত করেছে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্যকলা বিভাগও। বিভাগীয় প্রধান তথা ডিন ডঃ নির্মল কান্তি রায় বলেছেন, এ অঞ্চলের শিল্পের বিকাশে একসময় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন স্বপ্নেশ চৌধুরী। বরাকের শিল্প সত্যিকার অর্থে একজন অভিভাবককে আজ হারাল।

Author

Spread the News