শ্রীভূমি কংগ্রেসে টিকিট বাণিজ্যের বিস্ফোরণ, শামিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে পুলিশের দ্বারস্থ আছান
মোহাম্মদ জনি, শ্রীভূমি।
বরাক তরঙ্গ, ২০ মে : সীমান্ত জেলা শ্রীভূমির রাজনীতিতে নতুন বিস্ফোরণ, বরাক উপত্যকায় কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ গন্ধগোকুল এবার প্রকাশ্যে। শতবর্ষ প্রাচীন দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের করিমগঞ্জ তথা শ্রীভূমি জেলায় এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে টিকিট বণ্টন নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ধরেই ঘুরছিল বাতাসে। তবে এবার সেই অভিযোগ পেল তথ্যপ্রমাণের ছোঁয়া, সঙ্গে আইনিরূপও।
প্রাক্তন জেলা কংগ্রেস সাধারণ সম্পাদক বজলুল হক চৌধুরী আছান সদর থানায় মামলা দায়ের করেছেন প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক তথা প্রভাবশালী নেতা আমিনুর রশিদ চৌধুরী ওরফে শামিমের বিরুদ্ধে। মামলা অনুযায়ী, কংগ্রেস টিকিটের জন্য বিপুল অঙ্কের টাকা নেওয়া এবং সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে টিকিট বিক্রির গুরুতর অভিযোগ উঠেছে শামিমের বিরুদ্ধে।
গোটা ঘটনার সূত্রপাত এক ভাইরাল ভিডিও ঘিরে। শ্রীমন্ত কানিশাইল-বাশাইল জেলা পরিষদ আসনের কংগ্রেস নেতা সেলিম উদ্দিন টিকিট বঞ্চিত হয়ে ভিডিওর মাধ্যমে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে টিকিট দেওয়ার অভিযোগ আনেন। ভিডিওটি ভাইরাল হতেই কংগ্রেসের জেলা নেতৃত্ব ও প্রদেশ স্তরের ভূমিকায় প্রশ্ন উঠতে শুরু করে।
সেলিম উদ্দিনের দাবি, শ্রীভূমি জেলা কংগ্রেস সভাপতি রজত চক্রবর্তী ও প্রদেশ কংগ্রেস সাধারণ সম্পাদক শামীমের নেতৃত্বেই টিকিট বিক্রির এক সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে উঠেছে। ভিডিওতে দলের অভ্যন্তরীণ টিকিট বণ্টন প্রক্রিয়ার নানা অনিয়ম, অযোগ্য প্রার্থীদের দলীয় মনোনয়ন এবং যোগ্যদের বঞ্চনার চিত্র ফুটে ওঠে।
সেলিমের ভিডিও সামনে আসতেই এবার আরেক টিকিট বঞ্চিত, কংগ্রেসের একদা প্রভাবশালী নেতা আছান চৌধুরী তাঁর অভিজ্ঞতা ও অভিযোগ তুলে ধরেন থানায় মামলা দায়েরের মাধ্যমে।
মামলার বিবরণ অনুযায়ী, করিমগঞ্জ জেলার লক্ষীবাজার জেলা পরিষদ আসনে তাঁর আত্মীয়া আমিনা বেগম কংগ্রেসের প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। দলীয় টিকিট পাওয়ার লক্ষ্যে ৯ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে করিমগঞ্জ শহরের একটি অভিজাত হোটেলে আয়োজিত কংগ্রেসের প্রার্থী বাছাই পর্বে তিনি নির্দ্বিধায় নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচনী প্রক্রিয়া তদারকিতে ছিলেন শামিম চৌধুরী।
তবে নির্বাচনী ফল প্রকাশের আগে শামিম, আছান চৌধুরীকে বলেন প্রদেশ ও জেলা নেতৃত্বকে খুশি করতে হলে ৯ লক্ষ টাকা দিতে হবে। এর মধ্যে ৫ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা তাঁর নিজের হাতে দিতে হবে। শর্ত— টিকিট না পেলেও টাকা ফেরত দেওয়া হবে।

এই আশ্বাসে আছান সাক্ষীদের সামনে চার লক্ষ টাকা নগদ তুলে দেন শামিমের হাতে। অবশিষ্ট দেড় লক্ষ টাকা টিকিট নিশ্চিত হলে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে জানা যায়, আরও বেশি অর্থ নিয়ে অন্য প্রার্থীর হাতে তুলে দেওয়া হয় সেই টিকিট। আজও ফেরত আসেনি সেই চার লক্ষ টাকা।
শুধু এখানেই থেমে থাকেননি শামীম চৌধুরী। আছানের অভিযোগ, তাঁর বিরুদ্ধে এই বিষয় জনসমক্ষে তোলার জন্য মানহানির মামলা করেন শামিম। শুধু তাই নয়, সংবাদমাধ্যমের যে সকল প্রতিনিধি এই খবর প্রকাশ করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করা হয়।
আছান চৌধুরী বলেন, “আজ থেকে নয়, বহুদিন ধরেই বলে আসছি— বরাক উপত্যকায় এক চক্র কংগ্রেসকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। এই চক্রের মাথায় রয়েছেন শামিম চৌধুরী। তাঁর নেতৃত্বেই দলীয় টিকিট বাণিজ্য, প্রতারণা ও দালাল সংস্কৃতি চলছে।”
শুধু শামীমই নন, আছান সরাসরি অভিযোগ করেছেন যে, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ভূপেন বরাও এই সিন্ডিকেটের অংশ। তাঁর কথায়, “এই সিন্ডিকেটের হাত করিমগঞ্জ থেকে গৌহাটি পর্যন্ত বিস্তৃত। একে রুখতে না পারলে কংগ্রেস নামমাত্র একটি দল হয়ে যাবে, সংগঠন নয়।”
তিনি দাবি জানান— প্রদেশ সভাপতি ভূপেন বরা, সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রশীদ চৌধুরী ও শ্রীভূমি জেলা সভাপতি রজত চক্রবর্তীকে অবিলম্বে বহিষ্কার করে কংগ্রেসের প্রদেশ নেতৃত্ব গৌরব গগৈর হাতে তুলে দেওয়া হোক। দলকে দালালমুক্ত করার এটাই একমাত্র পথ বলে জানান তিনি।
এই ঘটনা সামনে আসার পরেও রাজ্য কংগ্রেস নেতৃত্বের তরফে এখনও কোনও স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া মেলেনি। বরং বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে— এমন গুরুতর অভিযোগের মুখেও কেন নীরব দল? আছান চৌধুরীর মতো নেতা, যিনি দীর্ঘদিন ধরে কংগ্রেসে সক্রিয়, তাঁকে বহিষ্কার করে উল্টে অভিযুক্তদেরই রক্ষা করা হচ্ছে কেন?
করিমগঞ্জের রাজনীতিতে এই ঘটনা যে বড় ধাক্কা, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শামীম চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, ভাইরাল ভিডিও, থানায় মামলা এবং সিন্ডিকেটের নেটওয়ার্ক— সব মিলিয়ে সীমান্ত রাজনীতির অভ্যন্তরে দানা বাঁধা ক্ষোভ এবার ফেটে পড়েছে।
দেখা যাক, কংগ্রেস হাইকমান্ড আদৌ এই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেয় কিনা। নাকি একে দমিয়ে রেখে, জনভিত্তি হারিয়ে আরও পিছিয়ে পড়ে বরাক উপত্যকায় শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী দলটি?