ধনী আর গরিবের মাঝেই আটকে থাকে মধ্যবিত্তরা

।। ববিতা বরা ।।
(লেখিকা উপ-পরিদর্শক, অসম পুলিশ)
২৫ ফেব্রুয়ারি : আমি শেষ হয়ে আসা টুথপেস্টটি চেপে-চেপে বের করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই বের হচ্ছে না। আমার পরেও আরও দুজনের দাঁত মাজতে হবে। তাই কখনও কখনও বেশি জোরে চেপে দিই, কখনও প্যাকেটটাকে পেঁচিয়ে নিই, আবার দরকার হলে কাঁচি দিয়ে কেটে নিই—যেভাবেই হোক, তিনজনের জন্য একটু হলেও বের করতেই হবে।

মুখে মাখার জন্য যে সানস্ক্রিন বা তেল ব্যবহার করি, সেটাও খুব সতর্কভাবে টিপে বের করি। তবুও মাঝে মাঝে একটু বেশি বেরিয়ে যায়। তখন আফসোস করে আবার বোতলের ভেতর ঢোকানোর চেষ্টা করি। আমি, মা আর বোন, এক বোতল তেল বা ক্রিম দিয়ে মাস দুয়েক চালানোর চেষ্টা করি। ভাগ্য ভালো, মা, আমি আর বোনের পায়ের মাপ প্রায় এক। তাই যখন একসঙ্গে বাইরে যাই, তখন একজোড়া চপ্পল নিয়ে অনেক সময় সমস্যায় পড়ি, কারণ একই জোড়া আমরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করি।
খাওয়ার সময়ও একই অবস্থা। খাবার শেষে পছন্দের ডাল বা ভাজির স্বাদ মুখে লেগে থাকে, কিন্তু আরেকটু চাইতে দ্বিধা করি। ভাবি, যদি মায়ের জন্য খাবার কম পড়ে যায়! তাই অনেকবার ভাবি, কিন্তু আলাদা করে চাই না।

বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার কথাই ধরুন, খালি হাতে যাওয়া যাবে না, কিন্তু যা দেব তা যেন মানানসই হয়। কী দেব! পছন্দের জিনিসটি দেওয়ার আগে দাম দেখে নিতে হয়, কারণ টাকা ভাঙানোর সময় অন্তরে হাজারো প্রশ্ন জাগে।

বাবা নিজের দরকারি জিনিসগুলো পরে নেবেন বলে রেখে দেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত নিতে দেখিনি। পুজো বা বিহুর সময় আমাদের জন্য নতুন জামাকাপড় আনলেও নিজের জন্য কাগজে মোড়ানো পুরোনো জামা এনে দেন।

ধনী আর গরিবের মাঝেই আটকে থাকে মধ্যবিত্তরা

বাবার জন্য কষ্ট হয়, যখন দেখি আমাদের ছোটখাটো চাহিদা পূরণ করতে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। মায়ের জন্যও কষ্ট হয়, যিনি আমাদের প্রয়োজন মেটাতে মনের শখ বিসর্জন দেন। কাপড়ের দোকানে ঝুলে থাকা মায়ের পছন্দের শাড়িটি কখনও কেনা হয় না। আমরা কখনও বাবার কাছে কিছু চাই না। বরং যখন বাবা কোথাও যান, আমরা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকি, কখন ফিরবেন তার অপেক্ষায় থাকি। ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত বাবার হাতে আনা একটা ছোট ডেয়ারি মিল্ক চকলেটও আমাদের কাছে অমৃতের মতো।কখনও পড়ার জন্য বই দরকার হলে বাবা নির্দ্বিধায় বলেন, “আজই কিনে আনো, কত টাকা লাগবে?” অথচ তার মানিব্যাগের ওজন খুব সামান্য।অনেকে বলে, “তোমাদের কী অভাব! গাড়ি আছে, ফ্রিজ আছে, বাড়িতে টাইলসও লাগানো আছে, নিশ্চয়ই টাকার অভাব নেই।” কিন্তু তারা জানে না, বাবা এখনো চোখের জল লুকিয়ে আমাদের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছেন। মাস শেষে যে সামান্য টাকা পান, তা দিয়ে একটা পুরো পরিবার চালাচ্ছেন। যখন আমরা বিছানায় আরামে ঘুমাই, বাবা তখন ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে কাজে বেরিয়ে যান। আমার হৃদয় কাঁপে। কখনও নিজেকে অক্ষম মনে হয়।
আমাদের মা সারাদিন রান্নাঘর থেকে শুরু করে গরু-ছাগল সামলানো পর্যন্ত বিশ্রাম পান না। মাকে এই কষ্ট করতে দেখে বুকের ভেতর কষ্টের সাপ জড়িয়ে ধরে। যারা বলে, “তোমাদের কী অভাব?” তারা কেবল বাইরের চাকচিক্য দেখে। ভেতরের বাস্তবতা দেখলে বুঝতে পারত, অভাব কাকে বলে। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। আমরা দু’বেলা খেতে পারছি, এর চেয়ে বড় সুখ আর কী! না থাকার জন্য দুঃখ নেই, কারণ যা পেয়েছি, তা যথেষ্ট। আমাদের চেয়ে আরও অনেক অভাবী মানুষ আছে। ধনী মানুষরা হয়তো টাকার দিক থেকে ধনী, কিন্তু হয়তো মনের দিক থেকে অভাবী। আবার অনেকের কাছে না-থাকার কষ্ট নেই, থাকার সুখও নেই। জানি না, কত টাকা থাকলে মানুষ ধনী হয় বা কত টাকার অভাবে দরিদ্র হয়। শুধু জানি, ধনী আর দরিদ্রের মাঝখানে আমাদের মতো মধ্যবিত্তরা আটকে থাকে।বাজার থেকে শুরু করে প্রতিটি ছোটখাটো ব্যাপারেই আমাদের সমন্বয় করতে হয়। আমরা এমন এক ধরনের মানুষ, যাদের সম্পদ থাকলেও অভাব মেটে না, আবার অভাব মেটানোর মতো সম্পদও থাকে না।

ধনী আর গরিবের মাঝেই আটকে থাকে মধ্যবিত্তরা

এমনকি অপ্রয়োজনীয়ভাবে জ্বালানো লাইট বন্ধ করেও বিদ্যুৎ বিল বাঁচানোর চেষ্টা করি। গরম লাগলেও একটাই ফ্যান চালিয়ে বসি। মা আমাকে কৃপণ বলে, কিন্তু এতে আমার আফসোস নেই। কারণ আমি মধ্যবিত্ত। আর মধ্যবিত্তের জন্যই কৃপণতা দরকার।

Spread the News
error: Content is protected !!