শিলচর ও লক্ষীপুরে ভূপেন হাজরিকাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি

কাছাড় জেলা প্রশাসনের মহা আয়োজন ঐক্য, মানবতা ও সংস্কৃতির সুরে মুখর হয়ে উঠল পুলিশ প্যারেড ময়দান

জনসংযোগ, শিলচর।
বরাক তরঙ্গ, ৫ নভেম্বর : বুধবার  বিকেলে শিলচরের পুলিশ প্যারেড ময়দান এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সাক্ষী রইল। প্রায় পাঁচ হাজার কণ্ঠ একসঙ্গে গাইলেন “মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য” এক মহিমান্বিত সুরে প্রতিধ্বনিত হলো মানবতার চিরন্তন বার্তা। ভারতরত্ন ড. ভূপেন হাজরিকার ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কাছাড় জেলা প্রশাসন ও জেলা সাংস্কৃতিক পরিক্রমা বিভাগের  যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই বিশাল সমবেত সঙ্গীতানুষ্ঠান পরিণত হলো ঐক্য, সহমর্মিতা ও মানবতার এক অনন্য উদযাপনে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খাদ্য,গনবন্টন ও ভোক্তা বিষয়ক, খনিজ ও খনিজ সম্পদ এবং বরাক উপত্যকা উন্নয়ন বিভাগের মন্ত্রী কৌশিক রায়। উপস্থিত ছিলেন আরও লোকসভা সাংসদ পরিমল শুক্লবৈদ্য, রাজ্যসভা সাংসদ কণাদ পুরকায়স্থ, শিলচর বিধায়ক দিপায়ন চক্রবর্তী, উদারবন্দ বিধায়ক মিহিরকান্তি সোম, কাছাড়ের জেলা আয়ুক্ত মৃদুল যাদব সহ বহু বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও প্রশাসনিক আধিকারিক।

দুপুর তিনটা বাজতেই যেন সুরের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল গোটা মাঠ জুড়ে। ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, চা-বাগানের শ্রমিক, স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য, এনসিসি ও এনএসএস ক্যাডেট, এনজিও প্রতিনিধি, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সরকারি কর্মচারী সবাই একত্রে মিশে গেলেন এক সুরে, এক অনুভবে। গোটা মাঠ জুড়ে প্রতিধ্বনিত হলো ড: ভূপেন হাজারিকার অমর সৃষ্টির ধ্বনি “মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য”যা যেন এক নবজীবনের আহ্বান হয়ে উঠল।

মুখ্যবক্তার ভাষনে মন্ত্রী কৌশিক রায় বলেন, “আজকের এই দিনটি প্রতিটি অসমবাসীর জন্য গর্বের দিন, কারণ আজ আমরা একসঙ্গে স্মরণ করছি সেই মানুষটিকে, যিনি সংগীতের মাধ্যমে মানবতার আদর্শকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন। ড. ভূপেন হাজারিকা কেবল একজন সংগীতশিল্পী নন, তিনি ছিলেন মানবতার কণ্ঠস্বর, যিনি সুরে ও কথায় মিশিয়ে দিয়েছিলেন ভালোবাসা, ন্যায়, সাম্য আর মানবিকতার মূল দর্শন।” তিনি আরও বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী ড. হিমন্ত বিশ্ব শর্মার দূরদর্শী চিন্তাভাবনা ও উদ্যোগের ফলেই আজ অসমের প্রতিটি জেলা এই দিনটিকে উৎসবের রূপে পালন করছে। মুখ্যমন্ত্রী বিশ্বাস করেন, ভূপেন হাজারিকার গান কেবল সুর নয় এগুলো অসমের আত্মার ভাষা, যা প্রতিটি মানুষকে একত্রে বেঁধে রাখে।”

মন্ত্রী আবেগভরে বলেন, ড. ভূপেন হাজারিকা  আমাদের শিখিয়েছেন সঙ্গীত কোনও বিলাসিতা নয়, এটি সমাজকে জাগিয়ে তোলার এক মাধ্যম। তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিতে আছে মানুষের কথা, শ্রমজীবী মানুষের কথা, নদীর বেদনা, প্রেমের চিরন্তন গান এবং মানবতার সুর। তিনি আমাদের দেখিয়েছেন, শিল্প মানে কেবল সৌন্দর্য নয়, শিল্প মানে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা। তাঁর ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গানটি আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভালোবাসাই মানবতার মূল শক্তি।”

রাজ্যসভা সাংসদ কনাদ পুরকায়স্থ তাঁর বক্তব্যে বলেন, “ড. ভূপেন হাজরিকা ছিলেন এক প্রজন্মের বিবেক। তিনি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, কষ্ট ও ভালোবাসাকে এক সুরে বেঁধেছিলেন। তাঁর গান আমাদের শেখায় মানবতার চেয়ে বড় কিছু নেই। তিনি আমাদের সংস্কৃতিকে বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর সুর আজও বেঁচে আছে মানুষের হৃদয়ে।”

লোকসভা সাংসদ পরিমল শুক্লবৈদ্য বলেন, “ড. ভূপেন হাজারিকার সৃষ্টিগুলি আমাদের সমাজের আত্মার প্রতিফলন। তাঁর প্রতিটি গান একেকটি জীবন্ত ইতিহাস। আজ সরকার যে উদ্যোগে এই অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে, তা তাঁর প্রতি এক অনন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি। আমি চাই, নতুন প্রজন্ম তাঁর গান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুক সহমর্মিতা, ভালোবাসা ও ঐক্যের পাঠ।”

জেলা আয়ুক্ত মৃদুল যাদব তাঁর স্বাগত ভাষণে বলেন, “আজকের এই দিনটি কাছাড় জেলার জন্য এক গর্বের দিন। এটি কেবল একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নয়, এটি ‘Unity in Diversity’-এর এক জীবন্ত উদাহরণ। আমরা সবাই একত্রে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি সেই মানুষটিকে, যিনি তাঁর গান দিয়ে গোটা জাতিকে এক সুতোয় বেঁধেছিলেন।” তিনি আরও জানান, প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি নতুন উদ্যোগ হিসেবে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী ও শিল্পীর জন্য ডিজিটালি স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেট প্রদান করা হবে, যা জেলা প্রশাসনের অফিসিয়াল পোর্টাল থেকে ডাউনলোড করা যাবে।

অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতিক অংশে ১৬ জন আমন্ত্রিত শিল্পী পরিবেশন করেন ড. ভূপেন হাজরিকার জনপ্রিয় গানগুলির সংকলন, যাঁরা পূর্বে খানাপাড়া, গুয়াহাটিতে তাঁর শতবর্ষ উপলক্ষে ১০০০ কণ্ঠের সমবেত সঙ্গীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের পরিবেশনা দর্শকদের আবেগাপ্লুত করে তোলে। অনুষ্ঠান শেষে অংশগ্রহণকারীরা মানবশৃঙ্খল গঠন করে আবারও সমস্বরে গাইলেন “মানুষ মানুষের জন্য”এক আবেগঘন মুহূর্তে মুখর হয়ে ওঠে গোটা পুলিশ প্যারেড ময়দান।

এরপর মন্ত্রী কৌশিক রায় আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. অমলেন্দু ভট্টাচার্য ও ড. প্রদোষ কিরণ নাথকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. রাজীব মোহন পান্ত-এর পক্ষ থেকে ড. ভূপেন হাজারিকার স্মারক মুদ্রা প্রদান করেন।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা আয়ুক্ত (সাংস্কৃতিক বিষয়ক) ফিলিস হ্রাংচাল, সহকারী আয়ুক্ত বহ্নিখা চেতিয়া, জুনালী দেবী, অঞ্জলি কুমারী, মাসি টোপনো এবং  দীপা দাস, সাংস্কৃতিক পরিক্রমা শাখা আধিকারিক ও তথ্য ও জনসংযোগ দপ্তরের উপ-সঞ্চালক, তথ্য ও জনসংযোগ বিভাগের আঞ্চলিক কার্যালয় শিলচর, সহ অন্যান্য প্রশাসনিক আধিকারিকবৃন্দ।

একই সঙ্গে লক্ষীপুর সম জেলা  আয়ুক্তের কার্যালয় প্রাঙ্গণে  সমান মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয় ড. ভূপেন হাজরিকার ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সমজেলা আয়ুক্ত ধ্রুবজ্যোতি পাঠক, অসম সরকারের মণিপুরি উন্নয়ন পরিষদের চেয়ারপার্সন রীনা সিংহ এবং লক্ষীপুর পুর বোর্ডের চেয়ারম্যান মৃণালকান্তি দাস। ছাত্রছাত্রী ও স্থানীয় শিল্পীদের কণ্ঠে আবারও ধ্বনিত হয় “মানুষ মানুষের জন্য”যা প্রমাণ করে, ড. ভূপেন হাজরিকার সুর আজও বরাক উপত্যকার মানুষের প্রাণে প্রবাহিত।

Spread the News
error: Content is protected !!