সৃজনশীল নাগরিক হতে পড়ুয়াদের আহ্বান উপাচার্য দিবাকর
জনতা কলেজের হীরক জয়ন্তী উদযাপন সমারোহ সম্পন্ন
বরাক তরঙ্গ, ১৭ নভেম্বর : রবিবার বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে এক ঝাঁক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গুণীজনদের উপস্থিতিতে অত্যন্ত সুন্দর ও সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হল দক্ষিণ কাছাড়ের অতি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কাবুগঞ্জ জনতা কলেজের হীরক জয়ন্তী উদযাপন সমারোহ। এদিন সকাল আটটায় কলেজের অধ্যক্ষ, অধ্যাপক, অধ্যাপিকা, ছাত্রছাত্রী ও প্রাক্তনীদের নিয়ে এক বিশাল শোভাযাত্রা দিয়ে শুরু হয় কর্মসূচির প্রথম পর্ব। পরে পতাকা উত্তোলন, শিলচর মেডিকেল কলেজ ব্লাড ব্যাংক আয়োজিত রক্তদান শিবিরের উদ্বোধন, কমিউনিটি আই কেয়ার, সক্ষম কর্তৃক বিনামূল্যে চক্ষু পরীক্ষা শিবিরের উদ্বোধন, প্রদর্শনী তথা বিক্রয়ের জন্য বিভিন্ন হস্তশিল্পের নানা ধরনের খাবার, আর্ট গ্যালারি এবং বইমেলার জন্য ১৬ই নভেম্বর খোলা ছোট ছোট স্টল গুলোর উদ্বোধন, হীরক জয়ন্তী প্রতীকের উন্মোচন, কলেজ ডকুমেন্টারি উন্মোচন শেষে মঞ্চে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে শুরু হয় হীরক জয়ন্তী অনুষ্ঠানের মূল পর্ব ও প্রকাশ্য বক্তৃতা সভা।
এদিনের অনুষ্ঠানের মুখ্য অতিথি মিজোরাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডঃ দিবাকর চন্দ্র ডেকা বক্তব্যের প্রথম লাইনে তুলে ধরেন শিক্ষার্জনের মূল উদ্দেশ্য। বলেন, বর্তমান সময়ে সমাজে ভালো ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে বা জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে শিক্ষার্জ্জনের যে দরকার তা অস্বীকার করা যায় না। তবে শিক্ষা অর্জনের এটাই মূল উদ্দেশ্য এমনটা কিন্তু তিনি মানতে চান না। তার কথায় শিক্ষা অর্জনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ভালো ও সৃজনশীল নাগরিক হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। এটাই প্রকৃত শিক্ষা বলে তিনি মনে করেন। বলেন, আইএএস, আইপিএস, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, শিল্পপতি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হওয়া বড় কথা নয়, চেষ্টা ও পরিশ্রম করলে সেটা সম্ভব। এসব জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হলেই যে ওরা দেশের ভালো নাগরিক তা কিন্তু নয়। কারন ওইসব জায়গায় যারা থাকেন তারা ভালো কাজ করলে ও স্বচ্ছতা সঠিকভাবে ধরে রাখতে পারেন না। আর সততা ও স্বচ্ছতা না থাকলে কখনো কোন ব্যক্তি ভালো মানুষ বা ভালো নাগরিক হয়ে উঠতে পারেন না বলে মত ব্যক্ত করেন উপাচার্য দিবাকর চন্দ্র ডেকা। একেবারে নিম্ন শ্রেণী থেকে উচ্চ শিক্ষা স্থল পর্যন্ত ছাত্র ছাত্রীদের শিক্ষাদানের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা দানের উপর গুরুত্ব আরোপ করে শিক্ষকদের এব্যাপারে অধিক দৃষ্টি দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। কাবুগঞ্জ জনতা কলেজের জন্মলগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত সকল ইতিহাস শুনে গর্ব বোধ করে বলেন যারাই এই কলেজের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন তারা এতোদঞ্চলের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত শিক্ষার কথা চিন্তা করেছেন বলেই আজ কলেজটি সমাজের বহু ব্যাক্তিকে বিভিন্ন ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। কলেজের প্রতি বছরের রেজাল্ট শুনেও তিনি সন্তোষ ব্যক্ত করে বলেন রেজাল্ট এভাবে অব্যাহত থাকলে আগামীতে ন্যাক থেকে “এ” গ্রেড বা “বি” ডাবল প্লাসের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হবে না এই কলেজ।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি সাংসদ পরিমল শুক্লবৈদ্য বক্তব্য রাখার শুরুতে কলেজের প্রাণ প্রতিষ্ঠাতা মহান ব্যাক্তিদের শ্রদ্ধা জানান। বলেন যারাই এই কলেজের প্রাণ দিয়েছেন তাদের মধ্যে হয়তো আজ অনেকেই আমাদের মাঝে নেই। আজ উনারা সবাই অনুষ্ঠানে থাকলে গর্বে তাদের মন ভরে যেতো। এবং তাদের সবাইকে একসাথে পেলে আমরাও গর্ব বোধ করতাম। কিন্তু তাদের অবদানের স্মৃতি কলেজের প্রতিটি কোণায় কোণায় যে জড়িয়ে রয়েছে সেটাই আমাদের প্রতি মূহুর্তে ওই গুণীজনদের স্মরণ করে দেবে। সাংসদ পরিমল শুক্লবৈদ্য বলেন, এই জনতা কলেজ দক্ষিণ কাছাড়ের এক বিরাট ঐতিহ্য বহন করে আসছে। এখান থেকে অনেকেই পড়াশোনা করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যশ ও মর্যাদার সাথে দেশের সেবা করে যাচ্ছেন। বলতে গেলে শিলচর শহরের পর গ্রাম কাছাড়ের এটাই প্রথম কলেজ। এক সময় যেখানে উচ্চ শিক্ষার কোন ব্যবস্থা ছিল না। উচ্চ শিক্ষা নিতে শিলচর শহরে যেতে হয়েছে সবাইকে। কাজেই এই কলেজের জন্য কিছু একটা করতে পারলে নিজের খুব ভালো লাগবে বলে জানিয়ে কলেজের সার্বিক উন্নয়নের জন্য তার দৃষ্টি থাকবে এবং সহযোগিতার হাত সবসময় প্রসারিত থাকবে বলে জানান তিনি। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নিরঞ্জন রায় অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্রের উত্তোরণের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, প্রতিটি শিক্ষা কেন্দ্রের একটা জীবন চক্র থাকে, যার উৎকর্ষ নিয়ে তাত্ত্বিকরা বলেছেন প্রতিটি শিক্ষাকেন্দ্রের চারটি পর্যায় থাকে। প্রথম হল প্রতিষ্ঠা, দ্বিতীয় হল সম্প্রসারণ, তৃতীয় হল স্থায়িত্ব এবং চতুর্থ হল উন্নয়ন। প্রথম তিনটি পর্যায় এই কলেজে বিদ্যমান তবে চতুর্থ পর্যায়কে আরো এগিয়ে নিতে হবে।
অধ্যাপক নিরঞ্জন রায় এও বলেন, কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ ড. দেবাশীষ পাল এখানে আসার দেড় বছর হয়েছে,এরমধ্যে কলেজের উৎকর্ষ সাধনে যথেষ্ঠ যত্নশীল এবং অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট দৃষ্টি রেখে কাজ করেছেন। অধ্যাপক ও অধ্যাপিকারা যে যার কর্তব্য যথাযথ ভাবে পালন করেছেন। কলেজের শৈক্ষিক পরিবেশ গঠনে সবাইর যৌথ প্রচেষ্টা আছে বলেই আজ কলেজটি ষাট বছরের এক প্রাণবন্ত যুবকের রূপ নিয়েছে বলে জানান তিনি। বলেন জাতীয় শিক্ষা নীতিতে কলেজের অনেক পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। আগামী ২০৩৫ সালের পর দেশের কলেজগুলোকে তিনটি ভাগে নিয়ে যাওয়া হবে। একটি হবে রিসার্চ ইন্সটিটিউশন, দ্বিতীয়টি হবে টিচিং ইন্সটিটিউশন এবং তৃতীয়টি হবে অটোনমাস কলেজ। এব্যাপারে ন্যাক যাবতীয় ডক্যুমেন্ট তৈরি করার কাজে হাত দিয়েছে বলে জানান। তিনি এও বলেন,একটা কলেজের শৈক্ষিক পরিবেশ উন্নত করা থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজকর্মের জন্য অধ্যক্ষকে স্বাধীন ভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। তবেই কলেজের শ্রীবৃদ্ধি অনায়াসে সম্ভব হবে। কলেজের শৈক্ষিক পরিবেশ উন্নত করে তুলতে শুধু অধ্যক্ষ, অধ্যাপক ও অধ্যাপিকাদের কর্তব্যটাই শেষ কথা নয়। এগিয়ে আসতে হবে ছাত্র ছাত্রীদেরও বলে মত ব্যক্ত করেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রক ড. সুপ্রবীর দত্ত রায়। এই কলেজে দীর্ঘ বছর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন, কিন্তু হীরক জয়ন্তী উদযাপন করার মত সৌভাগ্য তার হয়নি বলে জানান। এই কলেজের প্রতি তার একটা নাড়ির টান রয়েছে এবং সারাজীবন থাকবে। বলেন, বর্তমান অধ্যক্ষ ড. দেবাশীষ পাল কলেজের দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই ন্যাক টিমকে কলেজ পরিদর্শনে আনতে পেরেছেন। এটা অনেক বড় বিষয় বলে জানান তিনি। সভায় স্বাগত বক্তব্যে কলেজের ষাট বছরের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন অধ্যক্ষ ড. দেবাশীষ পাল। প্রকাশ্য সমাবেশে প্রাসঙ্গিক বক্তব্য রাখেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. প্রদ্যুষ কিরন নাথ, শিলচর ক্যান্সার হাসপাতালের পদ্মশ্রী ডাঃ রবি কান্নান, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডঃ স্বপন শুক্লবৈদ্য, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ডঃ অনুপ কুমার দে, কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি মোহন সিংহ প্রমুখ। ধন্যবাদ সূচক বক্তব্য রাখেন ভাইস প্রিন্সিপাল সুজাতা পালিত। অন্যান্যদের মধ্যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষা নিভাননী দেবী, অবসরপ্রাপ্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সুভাষ চন্দ্র নাথ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক কৃপানারায়ণ রায়, অধ্যাপিকা ডঃ মুন্নি দেব মজুমদার, সোমা ভট্টাচার্য, ডঃ সিরতাজ বেগম লস্কর, ডঃ উষা রাণী শর্মা, অধ্যাপক ডঃ এইচ নীরেন্দ্র সিংহ, ওয়াই প্রফুল্ল সিংহ, ডঃ পিনাকি দাস, ডঃ মনিসেনা সিংহ, ডঃ রবীন্দ্র সিংহ, সঞ্জিত মুশাহারি, ডঃ লালজুমলিয়েন, ডঃ রুমি দাস, লাইব্রেরিয়ান প্রদীপ সিংহ প্রমুখ।
এদিনের অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ড.সুদীপ্তা খেরসা ও গায়ত্রী সিংহ। বিকেল চারটায় অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা। সন্ধ্যা পাঁচটায় অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে মণিপুরী, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ও নেপালী নৃত্য পরিবেশন নিজ নিজ সম্প্রদায়ের শিল্পীরা। ধুনুচি নৃত্য পরিবেশন করেন বাঙালি সম্প্রদায়ের শিল্পীরা। এদিন মঞ্চে সংগীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট লোকসংগীত শিল্পী মঙ্গলা নাথ, মলয়া নাথ ভৌমিক, মাম্পী চৌধুরী সহ অন্যান্যরা। এদিন অনুষ্ঠানের শুরুতে আমন্ত্রিত অতিথিদের উত্তরীয়, ফুলের তোড়া ও মোমেন্টো দিয়ে সম্মান জানানো হয়। অনুষ্ঠানের মঞ্চে কলেজের বাংলা বিভাগ থেকে প্রকাশিত পত্রিকা “ভোরের পাখি” উন্মোচন করেন সাংসদ পরিমল শুক্লবৈদ্য। রাত নয়টায় হীরক জয়ন্তীর পুরো অনুষ্ঠান শেষ হয়।