বরাকে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বেকার সমস্যা, ই-অটো উপার্জনের ভরসা শিক্ষিত যুবকদের
।। প্রদীপ দত্তরায় ।।
(লেখক প্রাক্তন ছাত্রনেতা ও গৌহাটি হাইকোর্টের আইনজীবী)
২৮ জুন : এখন বরাক উপত্যকায় বেকার সমস্যা ভয়াবহ রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। বর্তমান সরকারের আমলে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে এই উপত্যকার বেকারদের বঞ্চিত করায় বেকারের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান সরকারের আমলে যে লক্ষাধিক চাকরি হয়েছে এর মধ্যে বরাক উপত্যকার চাকরি পাওয়া বেকারদের সংখ্যা ২১০০ জন। অথচ, জনসংখ্যা অনুপাতে চাকরি হওয়া উচিত বাইশ হাজার জনের। পূর্ববর্তী সরকারের আমলে চাকরিতে নিযুক্তির চিত্রটা এত বৈষম্যমূলক ছিল না। কর্মহীনতার জন্য বরাক উপত্যকার যুব সমাজ এখন দিশেহারা অবস্থায় রয়েছে। কারণ, এ উপত্যকায় রেজিস্ট্রিকৃত বেকারের সংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষ। কিন্তু এই উপত্যকায় বেকারদের চাকরি-বাকরির রাস্তা একপ্রকার বন্ধ। দেখা যাচ্ছে এ উপত্যকায় তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে স্থানীয়রা প্রাধান্য পাচ্ছে না। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে প্রার্থী এনে নিয়োগ করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে, স্থানীয়রা বেকারত্বের অভিশাপ মুক্ত হতে পারছে না। তাদের কোনও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে না। নির্বাচনের আগে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা প্রচার অভিযানে এসে জোর গলায় বলেছিলেন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদে স্থানীয় বেকারদের নিযুক্তি দেওয়া হবে। পরবর্তীকালে তিনি বলেছেন এক্ষেত্রে আইনগত সমস্যা রয়েছে। আইনগত সমস্যার দোহাই দিয়ে এভাবে এ অঞ্চলের বেকারদের বঞ্চিত করে রাখা হচ্ছে। এটা মোটেই যুক্তি-গ্রাহ্য নয়।
বেকারদের বিকল্প যে কর্মসংস্থান হবে সে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। এ উপত্যকায় শিল্প পরিকাঠামো বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। কাছাড় কাগজ কল বন্ধ হয়ে গেছে। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে যারা রুজি রোজগার করে বেঁচে বর্তে ছিলেন তাদের অবস্থা এখন সঙ্গীন হয়ে উঠেছে।যেহেতু বরাক উপত্যকায় কোনো সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান নেই, তাই কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে এ অঞ্চল পিছিয়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আনিপুরের চিনিকল, বদরপুরের বস্ত্র শিল্পের অনেক আগেই অকাল মৃত্যু ঘটেছে। বেসরকারি পর্যায়ে এখানে একমাত্র একটি সিমেন্ট কারখানা গড়ে উঠেছে। রয়েছে একটি বেসরকারি স্টিল প্লান্ট। বাকি কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কলকারখানা। ইটভাটা, ফুড প্রসেসিং ইউনিট, কুটির শিল্প, বয়ন শিল্প ইত্যাদি। এসবে ব্যাপক কর্মসংস্থানের তেমন কোনও সুযোগ নেই। বরাক উপত্যকায় বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, পলিটেকনিক, আইটিআই, ডেন্টাল কলেজ, ফার্মাসিউটিক্যাল কলেজ, নার্সিং কলেজ ইত্যাদি রয়েছে। এসব থেকে প্রতিবারই হাজার হাজার পড়ুয়া পাস করে বেরিয়ে আসে। কিন্তু তাদের সামনে কর্মসংস্থান নেই। তাহলে এই শিক্ষিত বেকাররা করবেটা কী? সরকার যখন কোন চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তখন দেখা যায় তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণির পদের জন্য মাস্টার ডিগ্রি পাস ছেলেমেয়েরা আবেদন করছে, এটা খুবই দুঃখের ব্যাপার। কিন্তু আবেদন করলে কি হবে? চাকরি তো মিলছে না। তাই বেকারত্বের বোঝা নিয়ে বছরের পর বছর কাটাতে হচ্ছে তাদের। কিছু কিছু বেকার কর্মসংস্থানের কিছুটা সুবিধা থাকায় দক্ষিণ ভারতে পাড়ি দিচ্ছে। সেখানে দিনরাত পরিশ্রম করে যে রোজগার হচ্ছে তার থেকে কিছুটা নিজের পরিবারকে পাঠাতে পারছে। তবে তাদের কাজ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কর্মক্ষেত্রে অনেক যুবককে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হয়। এই মৃত্যু দুর্ঘটনা জনিত না অন্য কিছু কারণ তা তদন্ত সাপেক্ষ।
বরাকের শিক্ষিত বেকারদের একাংশ ফাস্টফুডের দোকান খুলে রোজগারের চেষ্টায় যুক্ত হয়েছে। যারা স্থায়ী দোকান নিতে পারছে না তারা ভ্যানের উপর অথবা চলমান ঘরের আদলে ফুটপাতে দোকান খুলে রোজগার করতে নেমেছে। দেখা যাচ্ছে শিলচর শহরের অলিগলিতেও এখন গজিয়ে উঠেছে ফাস্টফুডের দোকান। কিছু কিছু আধুনিক রেস্তোরাঁ গজিয়ে উঠেছে যেগুলোতে মুখর চোখ খাদ্য পাওয়া যায়। তরুণ প্রজন্মের যুবক-যুবতীরা এইসব খাদ্যের দিকে ঝুঁকে গেছে। এইসব ফাস্টফুড স্বাস্থ্যসম্মত নয়। কিন্তু হলে কি হবে স্বাদের জন্য তরুণ প্রজন্ম এই ফাস্টফুড খাওয়া বেশি পছন্দ করছে। ফাস্টফুডের দোকানের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকায় এই ক্ষেত্রে রোজগারে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। ক্রেতাদের আকর্ষণ করার জন্য কোনো কোনো দোকানে ভিন প্রদেশের খাবার রাখা হচ্ছে। তাছাড়া শিলচর শহরে কর্পোরেট দুনিয়ার আন্তর্জাতিক মানের খাবারও মিলছে এখন। নতুন প্রজন্ম এইসব খাবার বেশি পছন্দ করছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই ক্ষেত্রটি ও বিকল্প কর্মসংস্থানের উপযুক্ত পরিবেশ বলে ধরে নেওয়া ঠিক নয়।
চাকরির বিকল্প হিসেবে এই উপত্যকার উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েরা নিজস্বভাবে যে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করবে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। অনেক অভিভাবকের আর্থিক সঙ্গতি নেই। ফলে সন্তানদের ব্যবসা-বাণিজ্যে ঠেলে দিতে পারছেন না। তাই এখন বরাক উপত্যকায় কুটির শিল্পের মত গড়ে উঠেছে ই-রিক্সা বা টুকটুকির ব্যবসা। এই টুকটুকি চালানোর সঙ্গে এখন প্রচুর পরিমাণে শিক্ষিত বেকাররা জড়িয়ে পড়ছেন। ই-রিক্সা ছাড়াও ইলেকট্রিক অটো কিনছেন কিছু কিছু শিক্ষিত বেকাররা। পরিবারের ভরণপোষণের জন্য একান্ত নিরুপায় হয়েই তাদের এই ব্যবসায় নামতে হচ্ছে। কিন্তু জনসংখ্যা অনুপাতে এই ধরনের যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি ভারসাম্য রক্ষা করতে পারছে না। রাস্তায় অনেক সময় একজন বা দুজন যাত্রীকে নিয়ে তাদের চলাচল করতে হচ্ছে। ফলে রোজগার হচ্ছে অনেক কম। বরাক উপত্যকার অন্যান্য স্থানের তুলনায় শিলচরে এই চিত্রটা বেশি দেখা যাচ্ছে। একান্ত নিরুপায় হয়ে বেকার যুবকরা পরিবহন শিল্পে আত্মনিয়োগের পথ বেছে নিয়েছে। শিলচর শহরকে দেখলে মনে হয় এটা এখন বৈদ্যুতিক বাহনের শহর। এমন কোন রাস্তা নেই, অলি গলি নেই যে রাস্তায় এই বৈদ্যুতিক বাহনগুলিকে দেখতে পাওয়া না যায়। এই বাহন কেনার জন্য ব্যাঙ্কগুলি ঋণ দিয়ে থাকে। তবে, এক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণ পাওয়ার শর্তগুলি পূরণ করতে হয়। ই-রিক্সার জন্য মাসিক কিস্তির পরিমাণ ডাউন পেমেন্ট এর উপর নির্ভর করে মাসে ৩০০০ থেকে ৬০০০ টাকা মধ্যে হয়ে থাকে। এটা সাধ্যের মধ্যে থাকলেও ই-অটোর জন্য মাসে ৯ থেকে ১২ হাজার টাকা ঋণের কিস্তি গুনতে হয়। ফলে একজন চালককে ব্যাংকের কিস্তি, বাহন মেনটেনেন্স , বিমার রাশি এবং নিজের পরিবারের ভরণপোষণের খরচ আলাদা করে হিসেব করে রাখতে হয়। তাদের ওপর আর্থিক চাপ এতটাই থাকে যে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রাস্তায় ঘুরে ঘুরে উপার্জনের চেষ্টা করে যেতে হয়। ব্যাংকের ঋণ খেলাপি হলে গাড়িগুলিকে টেনে নিয়ে যায়। ফলে ব্যাঙ্ক ঋণ পরিশোধ টাই তাদের কাছে সবচেয়ে জরুরী হয়ে দেখা দেয়। যাদের ব্যাঙ্ক ঋণ পাওয়ার সম্ভব নয় তাদের ঋণ নিতে হয় বিভিন্ন ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা, বন্ধন, আশা, কিংবা স্থানীয় কো-অপারেটিভ থেকে। এই ঋণের জন্য উচ্চ হারে সুদ গুনতে হয়। ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে অনেক যুবক অনেক সময় হতাশ হয়ে পড়ে। এই বাহন চালিয়ে তারা নিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাতে পারবে কিনা এ নিয়ে অনেকেই এখন সন্ধিহান হয়ে উঠেছেন। কারণ, প্রতিদিনই নতুন নতুন ই-অটো রাস্তায় নামছে। জানা গেছে, ই-অটো কেনার জন্য এখন শিলচরে ওয়েটিং লিস্টে থাকতে হচ্ছে গ্রাহকদের। গাড়ি কেনার জন্য ডাউন পেমেন্ট দিতে অনেকে জমানো অর্থ, পরিবারের লোকজনদের জমানো অর্থ এবং আত্মীয় পরিজনদের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিয়ে এই গাড়ি কিনে থাকেন। শিলচর শহরেই বর্তমানে কুড়ি হাজারের বেশি বৈদ্যুতিক রিকশা এবং ই-অটো চলছে। যার প্রায় ৭৫ শতাংশ অটোর মালিক কিস্তিতে গাড়ি কিনেছেন। অনেকে আবার এই গাড়ি কেনার পর কোন চালককে ভাড়া হিসাবে গাড়ি দিয়ে থাকেন। ই- রিক্সা এবং ই-অটো সব ক্ষেত্রেই তাই। তবে বর্তমানে শহরে ই -অটোর সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে ই -রিক্সার কদর কমতে শুরু করেছে। অনেকে পুরনো ই-রিক্সা অকেজো লোহার মত ওজন দরে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকে ই -রিক্সা বিক্রি করে ই -অটো কিনতে শুরু করেছেন। একদিকে যেমন এই ধরনের বাহনের সংখ্যা বাড়ছে অপরদিকে সৃষ্টি হচ্ছে ভয়ানক যান জোটের। শিলচরে ট্রাফিক ব্যবস্থার পরিকাঠামো অপর্যাপ্ত হওয়ায় প্রতিনিয়তই বাড়ছে যানজট। এমন কোন রাস্তা নেই যেখানে যানজট লাগে না। রাস্তায় যানজট বেড়ে যাওয়ায় কমছে যাত্রীর সংখ্যা। একই রুটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও কোনও কোনও তিন চাকার যানবাহনের চালক দিনে ২০০ টাকাও রোজগার করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। তবে ই -অটো মোটামুটি দ্রুতগামী গাড়ি হওয়ার জন্য কিছুটা বেশি রোজগার করতে পারছেন চালকরা। তবে, মূল্যবদ্ধির এই সময়ে এই রোজগার পর্যাপ্ত নয়।
শিলচর শহরের ক্রমবর্ধমান যানজট নিরসনের জন্য উড়ালপুল নির্মাণ করে যানবাহনের চাপ কমানো যেতে পারে। সরকার উড়ালপুল নির্মাণের ব্যাপারে ঘোষণা করার পরও এই প্রকল্প এখনো গৃহীত হচ্ছে না এটাও আশ্চর্যের ব্যাপার। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, শহরবাসীর সহযোগিতা পেলে উড়ালপুল নির্মাণ করা হবে। রাজ্যের অন্যান্য শহরে উড়ালপুল তৈরির সময় শহরবাসীর সহযোগিতার প্রশ্নটি তোলা হয়নি। কিন্তু শিলচরের ক্ষেত্রে এ প্রশ্ন কেন তোলা হচ্ছে এটা রহস্যজনক। শিলচরের মানুষ উড়ালপুলের বিরুদ্ধে অভিমত তুলে ধরেছে এমনটা আমার জানা নেই। কাজেই উড়ালপুলের স্বপ্ন দেখানোটা কি শুধুমাত্র ভোট দাতাদের মন জয় করার কৌশল? শিলচর শহরে যেহেতু রাস্তাঘাটের সংখ্যা কম। তাছাড়া যেসব রাস্তা রয়েছে সেগুলি পরিসর অনেক কম। এ অবস্থায় যানবাহনের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকলে তা কিভাবে চলাচল করবে সেটা বড় প্রশ্ন। কোন যাত্রীকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে হলে আজকাল ঘন্টারও বেশি সময় লেগে যায়। এই অবস্থায় প্রতিটি সড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচলের অনুমতি না দেওয়াই উচিত। একেক ধরনের যানবাহনের জন্য এক একটি রাস্তা কে নির্দিষ্ট করে দিলে, যানজটের সমস্যা অনেকটা লাখ হওয়া সম্ভব।
এই যে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার পরিবহন বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকছে এই পরিস্থিতি শুধু পরিবহণ সমস্যার ইঙ্গিতবহ নয়, বরং সমগ্র বরাক উপত্যকার কর্মসংস্থানের হতাশাজনক চিত্র তুলে ধরছে। সরকার বা প্রশাসনের তরফে কোনও কর্মসংস্থান নীতি নেই। পরিবেশ বান্ধব যানবাহন হওয়ায় ই রিক্সা বা ই অটো রেজিস্ট্রেশন নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সমস্যাটি দিনে দিনে বৃহদাকার ধারণ করছে। জনসংখ্যার তুলনায় এইসব বাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় শহরের অর্থনৈতিক ভারসাম্য এক ভয়াবহ সমস্যার দিকেই এগোচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন সমস্যাটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তখন হাজার হাজার যুবক আবার কর্মহীন হয়ে পড়বেন, এটা সত্যিই দুর্ভাবনার বিষয়। বেকার সমস্যা নিরসনে যদি সরকারদর্শক পদক্ষেপ না করে তাহলে এ উপত্যকায় বিদ্রোহের আগুনে জ্বলে উঠতে পারে। এ বিষয়টা শাসক দলের মাথায় রাখা উচিত। কারণ বঞ্চনা সইতে সইতে মানুষ একদিন বিতশ্রদ্ধ হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে এটাই বাস্তব।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
