জকিগঞ্জে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মুখোমুখি বিএনপির দুই পক্ষ, এলাকায় উত্তেজনা
বিশেষ প্রতিবেদক, সিলেট।
১৭ অক্টোবর : সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায় নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারে বিএনপিতে শুরু হয়েছে ‘দোষারোপের রাজনীতি’। নেতা–কর্মীরা একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়েছেন। একপক্ষ আরেক পক্ষকে নানান অপবাদের আখ্যা দিয়ে পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ করছে। স্বদলীয় প্রতিপক্ষের পার্টি অফিসে হামলা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী।
বর্তমান পরিস্থিতিতে জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ইকবাল আহমদ তাপাদার বনাম জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিদ্দিকুর রাহমান পাপলুর সমর্থকদের মধ্যে পুর এলাকায় এসব ঘটনা ঘটছে। উভয় পক্ষের মধ্যে টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। যেকোনো মুহূর্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাধার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে থানা-পুলিশের দাবি, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার রাতে জকিগঞ্জ পৌর শহরের এমএ হক চত্বরে আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে ছিদ্দিকুর রাহমান পাপলুর সমর্থকেরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন। এর আগে উপজেলার কালীগঞ্জ বাজারে আরো একটি বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
স্থানীয় বিএনপি সূত্রে জানা যায়, জকিগঞ্জ উপজেলায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই গ্রুপে সংঘর্ষ ও থানা কমপ্লেক্সের সামনের দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর করে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ছবি এবং সিদ্দিকুর রাহমান পাপলুর ছবি যুক্ত ফেস্টুন ভাংচুের ঘটনা ঘটেছে। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন।
সিলেট-৫ আসনে নির্বাচন করার লক্ষ্যে জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিদ্দিকুর রাহমান পাপলু কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর রাজনৈতিক কার্যক্রম পালন করে আসছেন পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শিব্বির আহমদ রণি, উপজেলা যুবদলের মাসুম আহমদ ও পৌর যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক মনিরুল ইসলাম রাজন।
অপর দিকে, একই আসনে প্রার্থী হওয়ার লক্ষ্যে সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ইকবাল আহমদ তাপাদার রাজনৈতিক কার্যক্রম পালন করে আসছেন। তাঁর রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন পৌর বিএনপির সভাপতি মাসুক আহমদ, সেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব আব্দুস সালাম ও পুর ছাত্রদলের সভাপতি পদপ্রার্থী সুলতান আহমদ।
এরমধ্যে বিএনপির এক অংশের নেতা–কর্মী সিদ্দিকুর রাহমান পাপলুকে সমর্থন দিচ্ছেন আরো এক অংশ ইকবাল আহমদ তাপাদারকে সমর্থন দিচ্ছেন। ভবিষ্যতে এই আসনে দলীয় মনোনয়ন ভাগিয়ে নিতে দলের মধ্যে অবস্থান মজবুত করতে চলছে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা। দিন যতই যাচ্ছে, ততই মাথা চাড়া দিচ্ছে দলীয় আধিপত্যের আধিক্য। দোষারোপ করছে একপক্ষ অন্যপক্ষে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্ট আওয়ামি লিগ সরকারের পতনের পর থেকে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে বিরোধ চলছিল। সাইকেল ও বাইক রাখা নিয়ে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। বিষয়টি স্থানীয়ভাবে সমাধানের উদ্যোগ নিলেও মীমাংসা না হওয়ায় দুই গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও হামলা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
আহতদের মধ্যে পুর যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক মনিরুল ইসলাম রাজন ও আহবায়ক জাবেদ আহমদ অবস্থা গুরুতর হওয়ায় এখনো সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। হাসপাতালে আহতদের দেখতে ছিদ্দিকুর রহমান পাপলু এ ঘটনার নিন্দা জানান এবং তাদের চিকিৎসার খোঁজ খবর নেন।
এদিকে, ইকবাল আহমদ তাপাদার নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি থেকে ঘটনার নিন্দা জানিয়ে দুঃখ প্রকাশ বলেন, ঘটনার সময় সিলেটে সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনায় থাকার কারণে মোবাইল সাইলেন্ট ছিল। তাৎক্ষণিক কল রিসিভ না করতে পারলেও ঘটনাটি শোনার পরপরই স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করে আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং বিষয়টি সামাল দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।
পরদিন জকিগঞ্জ এমএ হক চত্বরে সিদ্দিকুর রহমান পাপলুর সমর্থকরা বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তারা পুর বিএনপির কার্যালয়ে হামলা-ভাংচুরকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড উল্লেখ করে হামলাকারীদের ধরে আইনের আওতায় আনতে প্রশাসনকে ৭২ ঘন্টার আল্টিমেটাম দেন। পাশাপাশি জেলা নেতৃবৃন্দের কাছে এই হামলার সুষ্টু বিচার দাবী করেন। অন্যতায় জকিগঞ্জে দলীয় কর্মকান্ড স্থগিত থাকবে বলে জানান।
সমাবেশের সমাপনী বক্তব্যে পুর যুবদলের আহবায়ক শিব্বির আহমদ রনি বলেন, আমরা বিগত ১৭ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতির সাথে আছি। আমাদের গায়ে কেউ কোন টুকা দিতে পারে নাই। আমরা রাজনীতি করি মানুষের জানমালের হেফাজত করার জন্য, গুন্ডামী করার জন্য রাজনীতি করি না। রাজনের রক্তে আমার জামাকাপড় ভিজেছে, এই হামলার সুষ্ঠু দলীয় বিচার না হলে আমি রাজনীতি করবো না। এ সময় উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌর বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রাহমান পাপলু বলেন, ‘আমরা সুষ্ঠু রাজনীতিতে বিশ্বাসী। দলের নাম ভাঙিয়ে কাউকে বিশৃঙ্খলা করতে দেওয়া হবে না। একটি পক্ষ দলের গঠনতন্ত্র বিরোধী কাজ করে যাচ্ছে।’
জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ইকবাল আহমদ তাপাদার বলেন, ‘রাজনৈতিক ফায়দা নিতে আমাদের বিরুদ্ধে অযথা অভিযোগ তোলা হচ্ছে। হীন উদ্দেশ্যে কতিপয় নেতা–কর্মী দলের গঠনতন্ত্রবিরোধী কাজ করে যাচ্ছে।’
এদিকে, জকিগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক হাসান আহমদ বলেন, ‘জকিগঞ্জের মাটিতে আধিপত্য বিস্তারের কোন সুযোগ নেই! জেলা নেতৃবৃন্দের কাছে আমাদের বক্তব্য একদম পরিষ্কার। যারাই আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে সংগঠনের
সম্মান ক্ষুন্ন করছেন অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক।
জকিগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন সেলিম বলেন, ‘পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে দ্রুত রাজনৈতিক বিরোধ সুরাহা না করা হলে, যেকোনো মুহূর্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা জরুরি।’ এই ব্যয়াপারে জেলা বিএনপির হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
উপজেলা বিএনপির সভাপতি শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা জেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দকে বিষয়টি জানিয়েছি। যারাই অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। বিষয়টির সমাল দিতে জেলা নেতৃবৃন্দের সাথে আমাদের যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।
জকিগঞ্জ থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) এসএম মাহমুদ হাসান রিপন বলেন, এ ব্যাপারে এখনো কোনো অভিযোগ করা হয়নি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনিভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।