বাঙালি জাতির ইতিহাস প্রায় ৭ হাজার বছরের পুরানো, বাঙালিদের অবদান অনস্বীকার্য
।। প্রদীপ দত্ত রায় ।।
(লেখক প্রাক্তন ছাত্রনেতা ও গৌহাটি হাইকোর্টের আইনজীবী)
১১ আগস্ট : সারাদেশে বিশেষ করে হিন্দি বলয়ের বিভিন্ন রাজ্যে হঠাৎ করে বাঙালিদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশি তকমা সেটে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের ধর পাকর করে বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে গিয়ে পুশব্যাক করা হচ্ছে। হঠাৎ করে এ ধরনের অগণতান্ত্রিক এবং অমানবিক পদক্ষেপ কেন করা হচ্ছে এ নিয়ে নানা মহল থেকে প্রশ্ন উঠছে। দেশ স্বাধীন করার জন্য সবচেয়ে বেশি রক্ত ঝরালো যে জাতি তার প্রতি এই ধরনের বিদ্বেষ মূলক মনোভাব পোষণ করা হচ্ছে। বিষয়টা যথেষ্ট উদ্বেগের। দেশভাগের পর বাঙালিদের কোণঠাসা করে রাখতে অসমে বিদেশি বিতরণ আন্দোলনের নামে ভারতীয় বাঙালিদের যথেষ্ট হেনস্থা করা হয়েছে। নেলি-গহপুরের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এর জ্বলন্ত প্রমাণ। অসমে এনআরসি নবায়নের নামে যে বৈষম্যের রাজনীতি হয়েছে এর কোন তুলনা মেলা ভার। ৩৮ লক্ষ লোককে এনআরসির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই ভারতীয় নাগরিক। বর্তমানে গুজরাট, ওড়িশা, দিল্লি, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড সহ বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাদেশি উৎখাতের নামে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্থা করা শুরু হয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকরা বাংলায় কথা বলছেন বলেই তাদের বাংলাদেশি বলে তোপ দেগে দেওয়া হচ্ছে। অথচ এটা কারো অজানা নয় পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও বাঙালিদের বসতি রয়েছে ত্রিপুরা, অসম, ঝাড়খণ্ড, ছত্রিশগড়, উত্তর প্রদেশ, বিহার, রাজস্থান, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, আন্দামান সহ বিভিন্ন রাজ্যে। বাঙালিরা কর্মঠ জাতি হিসেবে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের নানা ধরনের উৎপাদনমুখী কর্মে যুক্ত। গুজরাটের সুরাতে ঘিরে এবং সোনার অলংকার প্রস্তুত শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের সিংহভাগই বাঙালি। কাপড় কোম্পানিতে ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বাঙালিরা নিযুক্ত রয়েছেন। বিভিন্ন রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিক এবং সিকিউরিটি গার্ডের কাজে দরিদ্র বাঙালিরা যুক্ত রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে হঠাৎ করে রনংদেহি রূপ নিয়ে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সরকার জেগে উঠলো কেন, এর অন্তর্নিহিত কারণ কি এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
বাংলাদেশে যেমন ২৮ কোটি বাঙালি রয়েছে ঠিক তেমনি ভারতবর্ষে বিভিন্ন রাজ্য মিলিয়ে রয়েছেন প্রায় ১৬ কোটি বাঙালি। এই জনসংখ্যার মানুষ বাংলাভাষায় কথা বলেন, এটা তো এমন কোন অপরাধ নয়। বাংলা ভাষায় কথা বলেন বলেই ভারতে বসবাসকারী বাঙালিরা বাংলাদেশি হতে যাবেন কেন? ভারতীয় নাগরিক বাঙালিদের বাংলাদেশি বলে তকমা সেটে দেওয়া একদিকে যেমন অসাংবিধানিক কাজ অপরদিকে যথেষ্ট অমানবিক। বাঙালিদের কোণঠাসা করে রাজনীতির ময়দান দখল করে রাখার যে গভীর ষড়যন্ত্রের যে বীজ স্বাধীনতার পর বপন করা হয়েছিল তা এখন ধীরে ধীরে মহীরুহতে পরিণত হচ্ছে। দেশের নানা স্থানেই এখন বাঙালিদের বাংলাদেশি বলে তকমা সেটে দিয়ে হেনস্থা করা হচ্ছে। এই হেনস্তার পিছনে গোপন রাজনৈতিক এজেন্ডা টা কি এটা অনেককে চিন্তিত করে তুলেছে। রাজনৈতিকভাবে বাঙালিরা বিভিন্ন দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকায় এই ঘটনায় কি পদক্ষেপ নেবেন সে বিষয়ে দ্বিধায় রয়েছেন। বাঙালি জাতিসত্তার সামনে ঘনিয়ে আসা এই বিপদ সম্পর্কে অনেকেই সচেতন নয়। তাই হেনস্থা প্রতিরোধে যে সম্মিলিত আওয়াজ ওঠার কথা সেটা উঠছে না। কোন কোন মহল থেকে কেবলমাত্র আওয়াজ তোলা হচ্ছে। সংসদে এ নিয়ে সরব ভূমিকা পালন করছে তৃণমূল কংগ্রেস। বিজেপির বাঙালি সমর্থকরা এ বিষয়ে নিয়ে যথেষ্ট দ্বিধাগ্রস্থ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর পক্ষে না বিপক্ষে কথা বলবেন সে নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন অনেকে।
পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের দেশের অন্যান্য রাজ্যে হেনস্তা রোধ করতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য সচিবকে পদক্ষেপ নিতে কড়া নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। আদালত যখন একটি বিষয়ে নির্দেশনা জারি করে তখন বুঝতে হবে বিষয়টির গভীরতা কতটা। বাঙালি হেনস্থা করার পিছনে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে। এ ধরনের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অবশ্য সরব হয়েছেন। তিনি প্রতিবাদ জানাতে রাজপথেও নেমে এসেছেন। কেন্দ্রে একটি শক্তিশালী সরকার থাকার পরও এ ধরনের ভাষাগত বা জাতিগত বিদ্বেষ তৈরীর ঘটনা ঘটায় সন্দেহের বাতাবরণ তৈরীর যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ওড়িশা রাজ্যে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর যে ধরনের আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ করা হচ্ছে, তা নিয়ে ওড়িশার কিছু মানুষ প্রতিবাদ মুখর হয়েছেন। তারাই প্রশ্ন তুলছেন, পশ্চিমবঙ্গে যেসব ওড়িয়া পান্ডা রান্নাবান্না বা ক্যাটারিং এর কাজে যুক্ত অথবা পাইপ মিস্ত্রির কাজে যুক্ত তাদের তো কোনো ধরনের হেনস্থা করা হচ্ছে না। তাহলে ওড়িশায় পরিযায়ী বাঙালি শ্রমিকদের কেন হেনস্থা করা হবে? দিল্লি বা গুজরাটে বাঙালিদের বস্তি উচ্ছেদ করে ঢালাও করে প্রচার করা হচ্ছে এরা বাংলাদেশি। বাঙালি বিদ্বেষী এই ঘটনাবলীর পেছনে যে গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে আমি মনে করি।
বাঙালি জাতির ইতিহাস প্রায় ৭ হাজার বছরের পুরোনো। বিশ্বখ্যাত বাংলা ভাষার ইতিহাসকার আচার্য সুকুমার সেন, আচার্য মোহম্মদ শহিদুল্লাহর মতে চর্যাপদকে বাংলা ভাষার আদিরূপ ধরলে বাংলাভাষা অনেক পুরনো। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালিদের অবদান সবচেয়ে বেশি। ক্ষুদিরাম বসু ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়ে গেছেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, আন্দামানে প্রথম স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। হিটলারের মত দোর্দণ্ডপ্রতাপ মানুষ নেতাজিকে সমীহ করতেন। বিপিনচন্দ্র পালের মতো বাগ্মী নেতা ভারতে বিরল ছিলেন। মাস্টারদা সূর্য সেন চট্টগ্রামে ব্রিটিশ অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেছিলেন। বাঙালিরা কখনো আঞ্চলিকতার বশবর্তী হয়ে জাতীয়তাবোধ থেকে সরে দাঁড়াননি । গোটা ভারতকে স্বাধীন করার জন্যই বাঙালি বিপ্লবীরা নিজেদের প্রাণ আহুতি দিয়ে গেছেন। আন্দামানের সেলুলার জেলে গেলে দেখা যাবে সেখানে যে তালিকা রয়েছে এর মধ্যে ৮০ শতাংশই বাঙালি বিপ্লবী। বাঙালিদের এই বিশাল অবদান প্রকারান্তরে চাপা দিয়ে রাখার জন্য বারবার ভিন্ন ভিন্ন চিত্রনাট্য রচনা করে আসা হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জনসংখ্যার নিরিখে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। আন্দামানে তিনি স্বাধীন ভারতের পতাকা প্রথম উত্তোলন করেছিলেন। তিনিই দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন এটা প্রায় সবাই ধরে নিয়েছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। পরে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম থেকে রাষ্ট্রশক্তির বয়ানে বলা হয় তাইওয়ানে তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য আজও উন্মোচিত হয়নি। নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য উন্মোচনে কয়েকটি কমিশন গঠন করা হলেও কমিশন এ কাজে সফল হয়নি।
বিজ্ঞান, সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে বাঙালিদের অবদান এতটাই বলিষ্ঠ যে অন্য কোন জাতির কাছে এটা এক প্রকার ঈর্ষার বিষয়। গাছের প্রাণ আছে এই তত্ত্ব উপস্থাপন করে সারা বিশ্বে ভারতের মাথা উঁচু করে দিয়েছিলেন বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ লেখে নোবেল পুরস্কার পেয়ে ভারতের মান বাড়িয়েছেন। জীবনব্যাপী সিনেমা শিল্পে অবদানের জন্য সত্যজিৎ রায় অস্কার পুরস্কার পেয়েছেন। এমন আরো অজস্র কৃতিত্বের নমুনা ছড়িয়ে রয়েছে। তাই, শুনতে খারাপ লাগলেও একথা সত্য হিন্দি বলয়ের বরাবরই একটা লক্ষ্য হলো বাঙালিকে কোনঠাসা করে রাখা। একসময় জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ উঠেপড়ে লেগেছিলেন। কিন্তু তাতে নানা মহল থেকে বাগড়া দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি হিসেবে প্রণব মুখার্জির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে তাকে বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী করা হয় পিভি নরসিংহ রাওকে। এরপরেও আরেকবার প্রণব মুখার্জির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মতো সুযোগ তৈরি হলে কংগ্রেস মনমোহন সিংহকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে। প্রণব যাতে ভবিষ্যতে কখনো প্রধানমন্ত্রীর দাবিদার হয়ে উঠতে না পারেন সেজন্য তাকে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করে রাজনীতির ময়দান থেকে আলবিদা জানানো হয়। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা রয়েছে যেখানে বাঙালিকে উপযুক্ত মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। দেশ গড়ে তোলায় যাদের অবদান তাদের সেই অবদানকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয়। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী কাশ্মীর সফরে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি। এ ধরনের অসংখ্য ঘটোনা রয়েছে যেগুলো বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে।
বাঙালি সাহিত্য সংস্কৃতি দিয়ে গোটা বিশ্বে ভারতকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে তাদের প্রতি এ ধরনের আচরণ মেনে নেওয়া যায় না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বন্দেমাতরম সংগীতের রচয়িতা। স্বতন্ত্রতার আন্দোলন চলাকালে বাংলার কবি সাহিত্যিকদের অবদান আন্দোলনের ইতিহাসের প্রতি পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। বাঙালিদের দেশপ্রেমের এই যে নিদর্শনের কোনও তুলনা হয় না । ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাঙালিরা। দেশ বিভাজনের বলি হয়েছিল বাংলা, সিন্ধু প্রদেশ এবং পাঞ্জাব কিন্তু বাংলা ছাড়া ওই দুটি প্রদেশের মানুষ সসম্মানে ভারতের মাটিতে পুনর্বাসন পেয়েছে। কিন্তু বাঙালিদের ক্ষেত্রে জুটেছে লাঞ্ছনা। পশ্চিমবঙ্গের মরিচ ঝাঁপিতে উদ্বাস্তু বাঙালিদের উপর গুলি চালানো হয়। জোর করে তাদের দণ্ডকারণ্যে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর অসমে বাংলাভাষীদের প্রতি যে আচরণ শুরু হয়, তা এখনও রূপ বদল করে বহমান। ভূমিপুত্র এবং বহিরাগত দুই শ্রেণিতে রাজ্যের মানুষকে বিভাজন ঘটানোর চক্রান্ত এখনও কাজ করে চলেছে। দেশ বিভাজনের পর শ্রীহট্টকে গণভোটের নামে প্রহসন করে পাকিস্তানে ঠেলে দেওয়া হয়। শ্রীহট্ট অঞ্চলের হিন্দু মানুষ নিরাপত্তার প্রশ্নে বাধ্য হয়েই অসমের অন্যান্য জেলাগুলিতে চলে আসেন। এই মানুষজনকে হেনস্থা করার জন্যই রচিত হয় ষড়যন্ত্র। ভাষা ও শিক্ষার অধিকার হরণের মতো ষড়যন্ত্র হয়েছিল। যদিও প্রবল প্রতিরোধে তা ভেস্তে যায়। স্বাধীনতার সময় অসমসহ গোটা উত্তর পূর্বাঞ্চল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। তখন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু অসমে এসে জননায়ক অরুনকুমার চন্দ, সতীন্দ্রমোহন দেব এবং বৈদ্যনাথ মুখার্জির সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়ে মুসলিম লিগ মন্ত্রিসভার পতন ঘটিয়ে গোপীনাথ বরদলৈর নেতৃত্বে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠন করে দিয়েছিলেন। নেতাজি সেই সময় উদ্যোগ না নিলে আজ গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত থাকতো। এ কথাটা স্মরণ করে বাঙালি মানুষের প্রতি যে ধরনের আচরণ করা উচিত তা কিন্তু করা হচ্ছে না। এটাই সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের ব্যাপার।
এনআরসির বকেয়া কাজ শেষ না করে অসমের বাংলাভাষী মানুষজনকে বাংলাদেশি বলে অভিহিত করা দুরভিসন্ধিমূলক। নিরাপদ ভোট ব্যাংক হওয়া স্বত্বেও বর্তমান সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি বঞ্চনা, অপমানের শিকার হয়েছেন রাজ্যের বাঙালিরা।রাজ্যে বাংলাদেশি শনাক্তকরণের জন্য ১৬০০ কোটি টাকা ব্যায় করে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বিজেপি সরকার। এই টাকা বিজেপি দল দেয়নি, এর প্রতিটি টাকা দেশের জনগণের কষ্টার্জিত আয় থেকে সংগৃহীত। কিন্তু চূড়ান্ত তালিকায় যে উনিশ লক্ষ বাদ গেছেন, তাঁদের বিবাদ, নিষ্পত্তি না করে ইচ্ছাকৃতভাবে এই প্রক্রিয়াকে ঝুলিয়ে রেখে যেভাবে তামাদি করা হয়েছে, তাঁতে এটা স্পষ্ট যে রাজ্য সরকার এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান চায় না। এবং সেজন্যই ভোট এলেই রাজ্যে এই বাংলাদেশি ইস্যুকে উসকে দেওয়া হয়।এনআরসির বকেয়া কাজ শেষ করলে এই ধরনের সন্দেহ বা মন্তব্যের প্রেক্ষিতই তৈরি হত না। তাই এটা নিশ্চিত যে ইচ্ছাকৃতভাবে এই ইস্যুকে ঝুলিয়ে রেখে নির্বাচনী সুবিধা আদায় করার চেষ্টা চলছে। কেউ যদি বাংলা ভাষায় কথা বলে তাহলে তাকেই বাংলাদেশি হিসেবে ধরে নেওয়া যাবে না। অসমে বসবাসকারী হিন্দু বাঙালিরা নিজেদের মাতৃভাষা বাংলা লিখে এসেছেন। এবারও তাই লিখাবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল বাংলা কথা বললেই বা বাঙালি পরিচয় দিলেই তাদের বাংলাদেশী বলে তকমা সেটে দেওয়ার এই প্রবণতা কেন?
গোটা দেশের বিভিন্ন রাজ্যে যে বাঙালি বিদ্বেষী পরিবেশ গড়ে উঠেছে এটা সামগ্রিক স্বার্থের পরিপন্থী বলেই আমি মনে করি। ভারতবর্ষে বসবাসকারী প্রতিটি জনগোষ্ঠীর এদেশের যেকোন স্থানে বসবাস করার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। সরকারি সুযোগ-সুবিধা লাভ অথবা নিজস্ব কর্মসংস্থান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কোনও জনগোষ্ঠীর সামনেই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা আইনত অপরাধ। কিন্তু সে ধরনের কাজেই এখন শুরু হয়েছে। ফলে নিগৃহীত মানুষজনকে আইনি সুরক্ষা দেওয়ার প্রশ্নটি এখন গুরুতর হয়ে দেখা দিয়েছে। ও সাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে মানুষকে এসব অনাচারের বিরুদ্ধে একজোট হতে হবে। কেবল বাঙালি নয়, প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর প্রাপ্য মর্যাদা পাওয়া উচিত। একইভাবে প্রতিটি জনগোষ্ঠীকে সুযোগ-সুবিধাও দেওয়ার সরকারের কর্তব্য। যদি কেন্দ্রীয় সরকার ভেবে থাকে এই ধরনের ক্রমাগত বঞ্চনা ও অপমানের পরও বাঙালিরা নিষ্ক্রিয় থাকবেন, তবে সেটা ভুল। ঝুলি ভরে ভোট দিয়েও যদি এমন অপমান, বঞ্চনার শিকার হতে হয়, তবে অবশ্যই বিকল্প চিন্তা করতে বাধ্য হবেন ধর্ম নির্বিশেষে বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী বাঙালিরা। কারণ, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়াই তো করতেই হবে। ইতিহাসের কাছ থেকে বাঙালিরা এ বিষয়টি অবশ্যই শিখে নিয়েছেন। বর্তমানে বাঙালিদের বিরুদ্ধে যে হিংসার বীজ বপন করা হচ্ছে তা ভবিষ্যতে অন্য জাতির ক্ষেত্রে প্রসারিত হবে না এর কোন গ্যারান্টি নেই। কাজেই সরকারের উচিত গোড়া থেকেই বিষয়টি অনুধাবন করে দৃঢ় পদক্ষেপ করা।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)