ভগৎ সিংয়ের আত্মবলিদান দিবসে জেলার নাম পরিবর্তন নিয়ে ছাত্র অভিবর্তন শ্রীভূমিতে

মোহাম্মদ জনি, শ্রীভূমি।
বরাক তরঙ্গ, ২৩ মার্চ : ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী ভগৎ সিং এর আত্মবলিদান দিবসে সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধি নিয়ে করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে করিমগঞ্জের আম্বেদকর পার্কে ছাত্র অভিবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। অভিবর্তনের সভাপতিত্ব করেন সঞ্চিতা শুক্ল। অভিবর্তনের শুরুতে শহীদ ই আজম ভগৎ সিং এর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেন যথাক্রমে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সুনীত রঞ্জন দত্ত, সমাজকর্মী রজত চক্রবর্তী, আইনজীবী অরুণাংশু ভট্টাচার্য, সমাজকর্মী বদরুল হক চৌধুরী, প্রাক্তন শিক্ষক পরিমল চক্রবর্তী, ছাত্র নেতা প্রজ্জোল দেব ও অভিবর্তনের সভাপতি সঞ্চিতা শুক্ল। মাল্যদানের পর উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন দেবশ্রী চক্রবর্তী। অভিবর্তনের মূল প্রস্তাব উত্থাপন করেন জয়দীপ দাস। মূল প্রস্তাবে বলা হয় যে জেলার জনগণের ইতিহাস, ঐতিয্য ও অস্তিত্বকে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িকতা, উগ্ৰপ্ৰাদেশিকতাবাদী ও আধিপত্যবাদী মানসিকতা নিয়ে করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। রাজ্য সরকার করিমগঞ্জ জেলার জনসাধারণের মতামতকে বিন্দুমাত্র পরোয়া না করেই, ছাত্র-শিক্ষক সংগঠন, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে আলাপ আলোচনার পথে না গিয়ে সমস্ত ধরণের গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে ভূলুণ্ঠিত করে  জেলার নাম পরিবর্তন করেছে। স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বাধীনোত্তর কালের বহু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস করিমগঞ্জ জেলার নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, বিপিন চন্দ্র পাল সহ প্রখ্যাত ব্যক্তিরা এই ঐতিহাসিক স্থানে এসেছিলেন। এইসব মহান ব্যক্তিরা সর্বদাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যথার্থ ভূমিকা পালন করেছিলেন। অথচ সরকার  এদের অসাম্প্রদায়িক এবং সমন্বয়ের চিন্তাকে পায়ে মাড়িয়ে এই অন্যায় সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তিকে বিকৃত করে এই মহান ব্যক্তিত্বের ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করেছে। এই ধরনের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রসূত কার্যকলাপ জাতি- ধর্ম- ভাষা- বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের সমন্বয়, বিশেষ করে হিন্দু -মুসলমান আপামর জনসাধারণের ঐক্য- সংহতির মূলে কুঠারাঘাত করেছে, যা কোনভাবেই সমাজের মঙ্গল সাধন করতে পারে না। এই নাম পরিবর্তনের সঙ্গে এই অঞ্চলের পরিকাঠামোগত ও জনজীবনের জীবন-জীবিকা সংক্রান্ত উন্নয়নের কোন সম্পর্ক নেই। অপ্রয়োজনীয় এবং অযৌক্তিক এই পরিবর্তন কার্যকরী করতে সরকারি কোষাগার থেকে বিশাল অর্থ ব্যয় হবে এবং অন্যদিকে জনসাধারণকে তাদের নথিপত্র পরিবর্তন করতে গিয়ে যথেষ্ট টাকা ব্যয় করতে হবে ও অভাবনীয় হয়রানির সম্মুখীন হতে হবে। মূল প্রস্তাবে এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়। এরপর একে একে বক্তব্য রাখেন প্রজ্জোল দেব, রজত চক্রবর্তী, সুনীত রঞ্জন দত্ত, বদরুল হক চৌধুরী, পরিমল চক্রবর্তী, সুজিত কুমার পাল এবং অরুণাংশু ভট্টাচার্য।

ভগৎ সিংয়ের আত্মবলিদান দিবসে জেলার নাম পরিবর্তন নিয়ে ছাত্র অভিবর্তন শ্রীভূমিতে

প্রজ্জোল দেব বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই উগ্ৰপ্রাদেশিকতাবাদী শক্তির বারংবার আক্রমণের শিকার হয়েছেন বরাক উপত্যকার জনগণ। ভোটার তালিকা সংশোধন, ডি ভোটার, ডিটেনশন ক্যাম্প, এন আর সি নবায়ন সহ বিভিন্ন ধরনের  চক্রান্তে বরাক উপত্যকার জনগণ বারবার হেনস্থা হয়েছেন। ১৯৬১, ১৯৭২, ১৯৮৬ সালে বরাক উপত্যকার জনগণের মাতৃভাষার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সেই আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বরাক উপত্যকার হিন্দু- মুসলিম বাংলাভাষী, মৈতেই, বিষ্ণুপ্রিয়া, হিন্দিভাষী জনগণ। বরাক উপত্যকার জনগণের কর্মসংস্থান লাভের একমাত্র মাধ্যম কাছাড় কাগজ কল ২০১৫ সাল থেকে বন্ধ, ডিলিমিটেশন করে বরাক উপত্যকার দুটো বিধানসভা কেন্দ্র কমিয়ে দিয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বৃদ্ধি করা হয়েছে, বরাক উপত্যকা থেকে আসাম সরকারের বহু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কার্যালয় এখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, বরাক উপত্যকায় যে সব সরকারি কার্যালয় রয়েছে তাতে পূর্বে স্থানীয় বেকার যুবক যুবতীদের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর বিভিন্ন পদে চাকুরী জুটত, বর্তমানে এডিআরই পরীক্ষা আয়োজন করে স্থানীয় বেকারদের বঞ্চিত করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে যাতে না উঠে তাঁর জন্য জনগণের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তন করেছে। রজত চক্রবর্তী বলেন, অসম সরকারের বর্তমান অর্থবছরের বাজেটে বরাক উপত্যকার জন্য উন্নয়নের জন্য অতি কম অর্থ বরাদ্দ করেছে। অসমের উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী ও সাম্প্রদায়িক সরকার বরাক উপত্যকার ছাত্র যুবকদের ভবিষ্যত বিপন্ন করছে। তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে আহ্বান জানান। সুনীত রঞ্জন দত্ত বলেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা কলেজগুলোতে ভর্তির জন্য ছাত্র ছাত্রীদের সর্বভারতীয় স্তরের যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষা সিইউইটি উত্তীর্ণ হতে হয়। গতবছর সাম্প্রদায়িক ও উগ্ৰপ্রাদেশিকতাবাদী অভিসন্ধি নিয়ে বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলায় এর পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়নি। ছাত্র ছাত্রীদের জন্য বাংলা মাধ্যমে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগও দেওয়া হয়নি। বাংলা বিষয়ের পরীক্ষা কেন্দ্র গুয়াহাটি, ডিব্রুগড়, কোকড়াঝাড় বা শিলং, আইজল, আগরতলা ইত্যাদি দূরবর্তী স্থানে স্থাপন করা হয়েছিল। যে সরকার ছাত্র ছাত্রীদের ভবিষ্যতের কথা ভাবে না তারা কি ভাবে করিমগঞ্জ জেলার জনগণের মঙ্গল চাইবে। তারা করিমগঞ্জ জেলার জনগণকে আরও বেশি বঞ্চিত করতে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

ভগৎ সিংয়ের আত্মবলিদান দিবসে জেলার নাম পরিবর্তন নিয়ে ছাত্র অভিবর্তন শ্রীভূমিতে

বদরুল হক চৌধুরী বলেন, বরাক উপত্যকার যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে মেডিক্যাল কলেজ, জেলা হাসপাতাল ইত্যাদির দুরবস্থা দেখলেই আসাম সরকারের উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব ও বৈষম্যের চিত্র পরিষ্কার ভাবে পরিলক্ষিত হয়। উগ্ৰ প্রাদেশিকতাবাদী শক্তির মদতপুষ্ট সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে পরিচালিত বর্তমান সরকার তার সীমাহীন বৈষম্যমূলক চরিত্র আড়াল করতে সুকৌশলে  বিভাজনের রাজনীতি তীব্রতর করছে যাতে জনগণের জীবন ও জীবিকার জ্বলন্ত সমস্যাগুলো নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে না উঠে। আইনজীবী অরুণাংশু ভট্টাচার্য বলেন সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি সরকারের ঐতিহাসিক স্থানের নাম পরিবর্তনের পদক্ষেপকে তীব্র ভৎর্সনা করেছে। তিনি রাজ্য সরকারের করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের অন্যায় ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের করেছে বিরুদ্ধে জেলার ছাত্র ছাত্রীদের ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

আজকের এই ছাত্র অভিবর্তনের প্রতিনিধি সম্মেলন বঙ্গ ভবনে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বক্তব্য রাখেন ছাত্র নেতা প্রজ্জোল দেব এবং হিল্লোল ভট্টাচার্য। সেখানে সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধি নিয়ে নাম পরিবর্তনের এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত তীব্র ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে পাঁচ জনকে আহ্বায়ক মনোনীত করে ৩৫ সদস্যের একটি শক্তিশালী ছাত্র সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি আগামী ৮ এপ্রিল জেলা জুড়ে প্রতিবাদ দিবস, গণসাক্ষর সংগ্রহ, ছাত্র ধর্মঘট সহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিরোধ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া পরিকল্পনা ঘোষণা করে।

Author

Spread the News