পুজোর নস্টালজিয়া : হারানো দিনের এক টুকরো ছবি

।। বিভূতিভূষণ গোস্বামী ।।
(এডিটর, দ্য মিজোরাম পোস্ট)
২৯ সেপ্টেম্বর : পুজো মানেই কি শুধু নতুন জামাকাপড়, প্যান্ডেল হপিং আর খাওয়াদাওয়া? নাকি এর সঙ্গে মিশে আছে আরও কিছু গভীর অনুভূতি—যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধূসর হয়ে যায়, কিন্তু কখনও মুছে যায় না। আমার কাছে পুজো মানে শৈশবের সেই হারানো দিনগুলো, যখন মন ভরে থাকত এক অবর্ণনীয় আনন্দ আর উদ্দীপনায়।
তখনকার দিনে পুজোর কেনাকাটা ছিল এক বড় উৎসব। বাবা আমায় নিয়ে যেতেন বলেশ্বর প্রসাদ কাকুর দোকানে নতুন জামা কিনতে। আর জুতো? সে তো লোকাল বাজার থেকেই কেনা হতো। মা আর কাকিমাদের জন্য কেনা হতো অতি সাধারণ শাড়ি। তবুও ওই সামান্য কেনাকাটাতেই মন এমন ভালো হয়ে যেত, যা আজ আর হাজার দামি পোশাকেও হয় না। এখন বুঝতে পারি, এই অনুভূতিটা ছিল হৃদয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার মতো। আজ সেই প্রদীপ অনুভব করার সময় কোথায়? জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে বুকে যেন একরাশ পাথর চেপে থাকে।

যৌবনে প্রেম যখন আসত, তখন মাঝে মাঝে সেই প্রদীপ জ্বলে উঠত, কিন্তু তা ছিল ক্ষণস্থায়ী। সেই ঘন ঘন বিচ্ছেদ, আর বুকে পাথর-চাপা অনুভূতিই ছিল আমাদের নিয়তি। তবুও শারদীয়া দুর্গা পুজো এলেই পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলো মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
আমাদের ছোটবেলায়, পুজো এলেই হালকা শীতের আগমন ঘটত। মা-কাকিমার সঙ্গে নতুনবাজারে পুজো দেখতে যাওয়ার স্মৃতি আজও আমার মনে উজ্জ্বল। সবুজ ধানগাছে ভরা মাঠের উপর কুয়াশার বিন্দু জমে থাকত। ঘাসের ওপর শিশির বিন্দুর ঝিকিমিকি আলোয় ভেজা আলপথ ধরে হেঁটে যেতাম।
বাড়ি থেকে জগন্নাথ মন্দিরে প্রণাম জানিয়ে, পশ্চিমের মাঠের সরু আলপথ ধরে শর্ট-কাট রাস্তা দিয়ে যেতাম নতুনবাজারে। প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতাম। ধানগাছ আর ঘাসের শিশিরে ভিজে যেত নতুন জুতো। সাবধানে পা ফেলে চলাটাই ছিল এক বড় চ্যালেঞ্জ। সত্যমনি স্যারের বাড়ি পেরিয়ে, চালের ব্যাপারী টুকন কাকুর বাড়ির পাশ দিয়ে আমরা প্রধান রাস্তায় উঠতাম।
প্রথমেই সালেপুর মহাদেববাড়ির পুজো। ঢাকের শব্দ, ভক্তদের কোলাহল—উৎসবের আমেজ এখান থেকেই শুরু হয়ে যেত। তারপর নতুনবাজার। তখনকার দিনে নতুনবাজারই ছিল গোটা অঞ্চলের মানুষের কাছে পুজোর মূল গন্তব্য। সব মিলিয়ে হাতে গোনা তিনটে পুজো হলেও, কালীবাড়ির পুজোর জৌলুস ছিল অন্যরকম। ঝলমলে আলোর মাঝে মা দুর্গার সে কী অপূর্ব রূপ! মা-কাকিমারা ভক্তিভরে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতেন।
আমি আর আমার খুড়তুতো ভাই (তখন ‘খুড়তুতো’ শব্দটার মানে বুঝতাম না, শুধু বলতাম দুই ভাই) মাকে প্রণাম করে দেওঘরির হাত থেকে ফুল, বেলপাতা আর নকুল-বাতাসা নিতাম। আমাদের একটাই চিন্তা থাকত, কখন মেলায় যেতে পারব। সত্যি বলতে, তখন মায়ের পায়ে ভক্তিভরে প্রণাম করার একমাত্র কারণ ছিল পরীক্ষায় ভালো ফল করা। এখন বুড়ো হয়ে সেই কারণের তালিকা আরও অনেক দীর্ঘ হয়েছে।

টিকলি বন্দুক, গাড়ি, বেলুন, সাপের খেলা—মেলার ঝলমলে আলোয় ঠাসা দোকানে-দোকানে মায়ের সঙ্গে ঘুরতাম। রামকৃষ্ণ কাকুর দোকানে মিষ্টি খেতাম আর বাড়ির জন্য এক কেজি জিলাপি নিয়ে ফিরতাম। বাড়ি ফেরার সময় রাত গভীর হতো, আর মাঠজুড়ে নেমে আসত কুয়াশার ঘন চাদর। সরু আলপথ ধরে হাঁটতে গিয়ে কাকিমার মাথা একটু টাল খেতো। অন্ধকারে সাবধানে পা ফেলতে হতো। একটাই চিন্তা ছিল, বন্দুকের টিকলিগুলো যেন ডাম্প না হয়ে যায়, আর নতুন জুতোটা যেন কুয়াশার জলে ভিজে একাকার না হয়ে যায়।
আজও যখন পুজো আসে, তখন সেই ছোটবেলার স্মৃতিগুলো মনের মধ্যে ভিড় করে আসে। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু পাল্টেছে, কিন্তু পুজোর সেই হারানো অনুভূতিগুলো আজও অমলিন।
