আগামী ৩ সেপ্টেম্বর করিমগঞ্জ জেলায় ১২ ঘণ্টার সর্বাত্মক হরতাল, সিদ্ধান্ত
মোহাম্মদ জনি, শ্রীভূমি।
বরাক তরঙ্গ, ৯ আগস্ট : করিমগঞ্জের বিপিন চন্দ্র পাল স্মৃতিভবনে স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্যমণ্ডিত করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তন প্রতিরোধ নাগরিক কমিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ সভায় আগামী ৩ সেপ্টেম্বর করিমগঞ্জ জেলায় ১২ ঘণ্টার সর্বাত্মক হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। শনিবার কমিটির অন্যতম আহ্বায়ক সুনীতরঞ্জন দত্তের সভাপতিত্বে আয়োজিত সভার শুরুতে গভীর উদ্বেগ ব্যক্ত করে বলা হয় গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলনের পরও সরকারের পক্ষ থেকে যেহেতু কোনও ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি তাই করিমগঞ্জ জেলার জনগণের অভিমত জোরালো ভাবে তুলে ধরতে আগামী ৩ সেপ্টেম্বর করিমগঞ্জ জেলায় সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে।

সভায় বাংলাভাষাকে বাংলাদেশি ভাষা বলা এবং মুখ্যমন্ত্রীর উচ্ছেদের বৈধতা প্রদানে অবিবেচক মন্তব্য সহ শাসক দলের আইটি সেলের অন্যতম প্রবক্তা অমিত মালব্যের সিলেটি উপভাষাকে বাংলাদেশি ভাষা বলা এবং আসাম সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যে দরিদ্র বাংলাভাষী জনসাধারণের উপর ধারাবাহিক আক্রমণের ঘটনার তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার জানানো হয়। সভায় বিভিন্ন বক্তারা বলেন, জনমতের তোয়াক্কা না করে, সমস্ত প্রকার গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে, চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধি নিয়ে, একপক্ষীয়ভাবে করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের সমস্ত ধরণের গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে ভূলুণ্ঠিত করে আসাম সরকার জেলার নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এটা করতে গিয়ে শত শত ঘটনার সাক্ষী ঐতিহাসিক স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বাধীনোত্তর কালের বহু গণআন্দোলন যথাক্রমে নানকার বিদ্রোহ, চরগোলার ঐতিহাসিক মুলুক চলো আন্দোলন, রক্তক্ষয়ী মাতৃভাষা আন্দোলন সহ অন্যান্য বহু গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের পিঠস্থান করিমগঞ্জ জেলার ভূমিকাকে মুছে ফেলা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, বিপিন চন্দ্র পাল সহ প্রখ্যাত ব্যক্তিরা এই ঐতিহাসিক স্থানে এসেছিলেন। এইসব মহান ব্যক্তিরা সর্বদাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকা পালন করেছিলেন। অথচ সরকার এদের অসাম্প্রদায়িক এবং সমন্বয়ের চিন্তাকে পায়ে মাড়িয়ে এই অন্যায় সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তিকে বিকৃত করে এই মহান ব্যক্তিত্বের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করেছে। অথচ এটাই ইতিহাস যে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা প্রশাসনিক সুবিধার কথা বলে সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধি নিয়ে যখন বঙ্গদেশকে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

সভায় উপস্থিত সদস্যদের অভিমত নাম পরিবর্তনের সঙ্গে এই অঞ্চলের পরিকাঠামোগত ও জনজীবনের জীবন-জীবিকা সংক্রান্ত উন্নয়নের কোন সম্পর্ক নেই। অপ্রয়োজনীয় এবং অযৌক্তিক এই পরিবর্তন কার্যকরী করতে সরকারি কোষাগার থেকে বিশাল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। তাছাড়া নথিপত্র পরিবর্তনে একদিকে যেমন জনসাধারণকে যথেষ্ট টাকা ব্যয় করতে হবে অন্যদিকে অভাবনীয় হয়রানির সম্মুখীন হতে হবে। তারা বলেন করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তন একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এই কথা সর্বজনবিদিত যে স্বাধীনতার পর থেকেই উগ্ৰ প্রাদেশিকতাবাদী শক্তির বারংবার আক্রমণের শিকার হয়েছেন বরাক উপত্যকার জনগণ। ভোটার তালিকা সংশোধন, ডি ভোটার, ডিটেনশন কেম্প, এনআরসি নবায়ন সহ বিভিন্ন ধরণের চক্রান্তে বরাক উপত্যকার জনগণ বারবার হেনস্থা হয়েছেন। ১৯৬১, ১৯৭২, ১৯৮৬ সালে বরাক উপত্যকার জনগণের মাতৃভাষার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সেই আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বরাক উপত্যকার হিন্দু- মুসলিম বাংলাভাষী, মৈতেই, বিষ্ণুপ্রিয়া, হিন্দিভাষী ও অন্যান্য ভাষিক সম্প্রদায়ের জনসাধারণ। আজও জেলার সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে নাম পরিবর্তনের মতো অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। বরাক উপত্যকার জনগণের কর্মসংস্থান লাভের একমাত্র মাধ্যম ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান কাছাড় কাগজ কল ২০১৫ সাল থেকে বন্ধ, কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগ না পেয়ে বরাক উপত্যকার যুবকেরা বহিঃরাজ্যে গিয়ে বেগার খাটতে বাধ্য হচ্ছে। বর্তমান সরকার বরাক উপত্যকার দুটো বিধানসভা কেন্দ্র কমিয়ে দিয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বৃদ্ধি করেছে, করিমগঞ্জ জেলার জেলা পরিষদ কেন্দ্রের সংখ্যা কর্তন করা হয়েছে। বরাক উপত্যকায় যে সব সরকারি কার্যালয় রয়েছে তাতে পূর্বে স্থানীয় বেকার যুবক যুবতীদের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর বিভিন্ন পদে চাকুরী জুটত বর্তমানে নিয়ম পরিবর্তন করে স্থানীয় বেকারদের বঞ্চিত করা হচ্ছে।
এছাড়াও বরাক উপত্যকার যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে মেডিকেল কলেজ, জেলা হাসপাতাল ইত্যাদির দুরবস্থা দেখলেই আসাম সরকারের উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব এবং বৈষম্যের চিত্র ফুটে উঠে। আজকের সভায় পুর্নবাসনের ব্যবস্থা না করে দরিদ্র মানুষকে উচ্ছেদ করার মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকারের চূড়ান্ত অমানবিক ও সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা জানানো হয়।

সভার পক্ষ থেকে অন্যায় ও অগণতান্ত্রিকভাবে করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আগামী ৩ সেপ্টেম্বর জেলার সর্বত্র হাট বাজার, দোকান পাঠ, অফিস আদালত, যান বাহন, স্কুল কলেজ বন্ধ রেখে সবাইকে ধর্মঘটে সামিল হতে আহ্বান জানানো হয়।
সভায় বক্তব্য রাখেন অরুণাংশু ভট্টাচার্য তাপস পুরকায়স্থ বদরুল হক চৌধুরী, জ্যোতিষ পুরকায়স্থ, আব্দুল কালাম তাপাদার, প্রজ্জ্বোল দেব, সৈয়দ সাহাবুদ্দিন, পরিমল চক্রবর্তী, নরুল হক, হিল্লোল ভট্টাচার্য, মফুর উদ্দিন, নৃপেন্দ্র চন্দ্র দাস, শান্তনু দাস, সুদিপ্তা দে চৌধুরী, প্রদ্যুৎ চন্দ্র দাস, পিকলু দে, ভবতোষ চক্রবর্তী, সাহাদাত আহমেদ চৌধুরী, বিনয় হালাম প্রমুখ।