আজও নজরুল প্রাসঙ্গিক, বিস্তার ঘটুক চেতনার
।। আশু চৌধুরী ।।
২৬ মে : জাতপাত-ধর্ম’ এই বিভেদের প্রাচীর ভেঙে দেওয়ার নজরুলের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল রাশিয়ার জারতন্ত্রের পতন। রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলামকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। প্রথম মহাযুদ্ধ চলাকালীন রুশ বিপ্লবের মতো ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা কবির চিন্তাধারায় ছাপ ফেলে দেয়। ১৯১৭ সাল। রুশ বিপ্লবের সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের বিশেষ করে বাংলার জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের মধ্যে অনেকে সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। এঁদের মধ্যে প্রথম মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন মানবেন্দ্রনাথ রায়, ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত, মুজফফর আহমদ প্রমুখ। তাঁদের চেষ্টায় ও ব্রিটিশ কম্যুনিস্ট পার্টির আগ্রহে মার্কসীয় চেতনা ভারতীয় তরুণদের মধ্যে মড়াতে শুরু করে। আর বাংলার সাম্যবাদী সংগঠনের প্রধান নেতা ছিলেন মুজফফর আহমদ। তাঁর সাহচর্যে এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন প্রথম বাঙালি কবি হিসেবে কাজি নজরুল ইসলাম। সেখান থেকেই রাজনৈতিক জীবন শুরু কবির। সৈনিক জীবন ত্যাগ করে নজরুল ইসলাম বঙ্গীয় মুসলিম। সাহিত্য সমিতির কার্যালয়ে আশ্রয় নিয়ে মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে বসবাস শুরু করেন। আর আহমদ তো সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করার নায়ক। তাঁরই ছত্রচ্ছায়ায় কবির রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ শুরু। আহমদের সঙ্গে বিভিন্ন সভা-সমিতিতে বক্তৃতাও দিতে শুরু করেন বিদ্রোহী কবি। কিন্তু কবি তাঁর কলমের যতি টানেননি। এই সমাজতান্ত্রিক চেতনায় তাঁর কলম শক্ত হয়ে যায়। আরও প্রতে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে ও রাশিয়ার বিপ্লবের জয়ে কবি তাঁর লাঙ্গল ও গণবাণী পত্রিকায় প্রকাশ করেন সাম্যবাদী ও সর্বহারা কবিতা। কিন্তু কবি বেশিদিন সক্রিয় রাজনীতিতে থাকেননি। সাহিত্য রাজনীতিতে থেকে যান। আর সাহিত্য রাজনীতিতেই গোটা দেশে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। লেখনীর মধ্য দিয়ে দেশের বিপ্লবীদের উৎসাহ, অনুপ্রেরণা ও চেতনা জাগিয়ে দেওয়ার সংগ্রাম চালিয়ে যান। কবি মুজফফর আহমদের সঙ্গে থাকলেও তাঁদের দলের সদস্যপদ গ্রহণ করেননি। ১৯২০-এ জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে অংশ নিতে চান। এই কংগ্রেস সমর্থনের জন্য কলকাতায় যান। কিন্তু কংগ্রেস থেকে কোনও সমর্থন না পাওয়ায় একাই লড়ার সিদ্ধান্ত নেন। নির্বাচনে তিনি বুঝতে পারেন সক্রিয় রাজনীতিতে বিশেষ স্থান নেই। ফলে সেখান থেকে সরে গিয়ে সাহিত্যের মাধ্যমে রাজনৈতিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ অব্যাহত রাখেন। একের পর এক কবিতা লেখে চিন্তার প্রকাশ ঘটান। এভাবেই সংগ্রামের আপসহীন ধারার প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন। কবির কোনও ব্যাঘাত ঘটেনি স্বাধীনতা আন্দোলনের দু’টি ধারাকে। তাই কবি নজরুল ইসলাম কবিতায় বলছেন-‘সুতা দিয়া মোরা স্বাধীনতা চাই বসে বসে কান গুণি
জাগরে জোয়ান ব্যত ধরে গেল মিথ্যার তাঁত বুনি।’ এভাবে আপসকামীদের সতর্ক করে জানিয়ে দেন এমন স্বাধীনতা দেশের শোষিত নাগরিকরা চান না। কবির এমন সতর্কবাণী ও চিন্তার সঙ্গে আপসকামী নেতৃবৃন্দের দ্বন্দ্ব বাবে। দেশের প্রধান দুটি সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতা সংগ্রাম এগিয়ে নিতে পিছ-পা হননি। সাম্যবাদী আন্দোলন সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালিয়ে যান। আপসহীন মুসলিম ঐক্যকে শক্তিশালী করতে অসহযোগ খিলাফত ও আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। এই সংগ্রাম দুটি ভারতীয় হিন্দু-মুসলিমের সম্মিলিত সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত ছিল।
ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের জন্য জাতপাত, ধর্মভেদের বিরুদ্ধে তিনি জেহাদ চালিয়ে যান। বলেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ অভেদ ধর্ম জাতি।’ ব্রিটিশ সরকারের হিন্দু-মুসলিম ভাগ করে শোষণ ও শাসন নীতির বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। বলেন, ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?’ এভাবে তিনি ঐক্যের জন্য কাউকে তোয়াক্কা না করে কলমযুদ্ধ শুরু করলেন। তিনি একটি কথা বারবার বলতেন, ‘ধর্ম কি কাঁচের মত ঠুনকো যে একটুতেই ভেঙে যাবে। এইসব কারণেই আমি এইরকম আস্তিকদের চেয়ে নাস্তিকদের বেশী ভক্ত, বেশী পক্ষপাতী। তিনি দুই সম্প্রদায়ের মৌলবাদী শক্তিকে কটাক্ষ করেছেন। তিনি তাঁর প্রবন্ধে, লেখার মধ্যে তা ফুটিয়ে তোলেন। বলেন, ‘উহালের প্রত্যেকের মুখ শয়তানের চেয়েও বীভৎস, শূকরের চেয়েও কুৎসিত, হিংসার কদর্যতায় উহাদের গাত্রে অনন্ত নরকের দুর্গন্ধ।’ কবি দুটি আন্দোলন মৌলবাদী শক্তি ও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সমানভাবে কলম দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যান। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘মহাবিদ্রোহ রণকান্ত আমি সেইদিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না।’
বিদ্রোহী কবির ওপর নেমে আসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আঘাত। বই নিষিদ্ধ সহ কারাবরণ করতে হয়। নিষিদ্ধ হয় ‘যুগবাণী’, ‘বিষের বাঁশি’ ও ‘ভাঙার গান’। ‘প্রলয় শিখা’ ও ‘ধুমকেতু’তে আগমনী কবিতার জন্য কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছে। কারাবরণ করেও বিদ্রোহ থামাননি। কারাগারে অন্যান্যদের নিয়ে বিভিন্ন দাবিতে অনশন শুরু করেন। দেশবন্ধু, বিশ্বকবি, মা জাহেদা খাতুন, মাতৃসম বিরজাসুন্দরীদেবী এবং সর্বস্তরের জনগণের আবেদনে উনচল্লিশ দিনের অনশন ভঙ্গ করেন।
জাতি, সমাজ ও দেশের জন্য আপসহীন সংগ্রাম করে যান বিদ্রোহী কাজি নজরুল ইসলাম। এই বিদ্রোহী কবি, যিনি সামোর গান গেয়ে গেছেন, মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে জেহাদ করার পরও তিনি যখন অসুস্থ, শয্যাশায়ী তখনই পাশে দাঁড়ালেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তথা হিন্দু মহাসভার নেতা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। তাঁর চিকিৎসার খরচ জোগাতে নিজেকে সভাপতি ও কোষাধ্যক্ষ হয়ে কমিটি গঠন করেছিলেন।
ব্রিটিশ শেকল থেকে দেশ মুক্ত হওয়ার প্রায় সত্তর বছরের কাছাকাছি। কিন্তু আজও কাজি নজরুলের স্বপ্নপূরণ হয়নি। জাতপাতের ভেদাভেদ আজ দেশের সর্বত্র। শুধু তা নয়, নজরুল যেটা ভাঙতে চাইছিলেন, আজ তা শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। দেশের শাসনভার গ্রহণে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। রাজনীতিবিদের প্রধান হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের মতো দেশের তাবড় তাবড় নেতারা ভেদাভেদকে কাজে লাগিয়ে ফায়ল তুলছেন। ধর্মের সুড়সুঁড়ি তো রয়েছে বটেই। এরমধ্যে আবার জাতপাত নিয়ে চলছে রাজনীতি। দেশের যে রাজ্যে যেটা কাজ করছে, সেটা ব্যবহার করতে কারও কোনও দ্বিধাবোধ নেই। উদ্দেশ্য এক, গরিব সাধারণ মানুষকে বিভাজন করে ফায়দা তোলা। গোটা দেশে হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ পুনর্জীবিত করতে মৌলবাদী সংগঠনগুলোর নিরলস প্রচেষ্টা কায়েম রয়েছে। এছাড়াও মধ্যযুগের মতো দলিতদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে জাতপাত, ভেদাভেদকে চাঙা করতে কেউই পিছিয়ে নয়। বিদ্রোহী কবি বুঝতে পেরেছিলেন, জাতপাত, ধর্মের উর্ধ্বে উঠে না এলে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন শক্তিশালী করা যাবে না। পাশাপাশি জাতির উন্নয়নও হবে না। ঐক্যের শক্তিকে সহজে ধ্বংস করা যায় না। সে-কথা আজ দেশের পুঁজিপতিদেরও বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়নি। দেশের পুঁজিপতিরা শক্তির ঐক্য যেন না হায় সেজন্য কিছু রাজনৈতিক নেতা
ও ধর্মীয় নেতার মধ্য দিয়ে বিভাজন
প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখছে। তাদের কর্মপন্থায় গোটা দেশে এক আতঙ্ক বিরাজ করছে। জাতপাত, ধর্ম এমনভাবে সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপন করা হচ্ছে, নিরীহ মানুষ ধর্মান্ত হয়ে উঠছেন। এতে উভয় সম্প্রদায়ের সচেতন মহল, বুদ্ধিজীবী, সমাজদরদি মানুষ নানা আশঙ্কায় রয়েছেন। অতি সাধারণ বিষয়কে সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে শাস্তি, সম্প্রীতি ও ঐক্যের ফাটল ধরানোর প্রচেষ্টা গোটা দেশে। কিন্তু নজরুল ইসলাম তারই বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। সমগ্র দেশের সঙ্গে বরাকেও একই প্রচেষ্টা। কবি যে দুই সম্প্রদায়ের মিলন ঘটাতে চাইছিলেন, সেই সম্প্রদায়গুলোর রাজনৈতিক নেতা বিচ্ছেদ করার জন্য মরিয়া। অসম রাজ্যে অসমিয়া ও অন-অসমিয়া নিয়ে সাধারণ মানুষ নানাভাবে আতঙ্কিত। কখন কী ঘটবে এমন একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ রাজ্যের বহু জেলায়। সে-সময় বরাককে অশান্ত করার প্রয়াস শুরু হয়েছে। কবি কাজি নজরুল ইসলাম এদের বিরুদ্ধেই কলম ধরেছিলেন। ফলে আজকের লড়াইয়েও তাঁর প্রাসঙ্গিকতা সমানভাবে রয়েছে। আজ ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে দেশের কোণায় কোশায় মৌলবাদী শক্তি। সেই শক্তি গ্রাস করে নিচ্ছে যুবসমাজকে। তার প্রতিফলন শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় নয়, বাস্তবেও ঘটছে। আমাদের উপত্যকায়।
একদল যুবকের সেই শক্তির লালন-পালনে ভয়ানক রূপ নিচ্ছে। অবুঝ যুবকদের মাথা ধোলাই করে অপ্রীতিকর কাজের মাধ্যমে নিজের জায়গাকে শক্ত করতে মরিয়া রাজনৈতিক দলের নেতারা। উপত্যকায় গজিয়ে ওঠা মৌলবাদী শক্তিকে প্রতিহত করতে এবং সেই যুবকদের রক্ষার আন্দোলনে কবি নজরুলের আদর্শ আজও প্রাসঙ্গিক। তাঁর আদর্শে, চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে ঐক্যের আন্দোলনকে সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে হবে আমাদেরই। আর ঐক্যই সমাজকে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে দেয়।
