মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুর উপস্থিতিতে পাথারকান্দিতে রথযাত্রার মহোৎসব
মোহাম্মদ জনি, পাথারকান্দি।
বরাক তরঙ্গ, ৩ জুলাই : বর্ণিলতা, ভক্তি আর সংস্কৃতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন হয়ে উঠেছিল এবারের পাথারকান্দির ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা। বৃহস্পতিবার বিকেলে মুন্ডময়লা এলাকায় জনসমুদ্রের মাঝে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসব যেন নতুনভাবে তুলে ধরল এই আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যকে।
উৎসবের বিশেষ মুহূর্তে উপস্থিত ছিলেন অসম সরকারের পূর্ত, মৎস্য ও পশুপালন বিভাগের মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু পাল। তিনি রথযাত্রার উদ্বোধন করেন এবং বলেন, “রথযাত্রা শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়—এটি আমাদের সমাজের ঐক্য, সম্প্রীতি ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। এই ঐতিহ্য ভবিষ্যত প্রজন্মের মধ্যে সজীব রাখা সকলের দায়িত্ব।”

এদিন আষাঢ় মাসের শুভ তিথিতে সকাল থেকেই রথতলা, মুন্ডময়লা ও আশপাশের অঞ্চল থেকে হাজারো ভক্ত এসে ভিড় জমান। জয় জগন্নাথ ধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে গোটা শহর। সুসজ্জিত রথ, পুষ্পমাল্য, আলোকসজ্জা, উলুধ্বনি আর শঙ্খনাদে যেন পাথারকান্দি পরিণত হয়েছিল এক অনন্ত আনন্দলোকের দৃশ্যে।

অসম-ত্রিপুরা আট নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে এগিয়ে চলা বেস কয়েকটি রথ শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা রথগুলোর এক সঙ্গে মিলিত হয় মুন্ডমালা খেলার মাঠে, যেখানে তৈরি হয় এক বৃহৎ রথমেলার আবহ। এই মিলনমেলাকে ঘিরে আয়োজিত হয় প্রসাদ বিতরণ, ধর্মীয় আলোচনা, পুজা এবং মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা।

এ বছরের রথযাত্রার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন দিক ছিল বিশাল কাঠের রথটি—যার গায়ে ছিল মনোমুগ্ধকর কারুকাজ, রঙিন পতাকা ও প্রভু জগন্নাথের প্রতিকৃতি। নারী, পুরুষ, শিশু থেকে বৃদ্ধ—সকলেই একসাথে রশি টেনে রথ টেনে নিয়ে যান নির্ধারিত পথে। সেই দৃশ্য যেন হয়ে ওঠে এক অভিন্ন আত্মার বহিঃপ্রকাশ।

সন্ধ্যায় মুন্ডমালা ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় ভজন, লোকসংগীত, নৃত্যনাট্য ও স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় সমৃদ্ধ এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে ধর্মীয় আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বিশিষ্ট পণ্ডিত ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিত্বরা। তাঁরা বলেন, জগন্নাথের রথ টানার মধ্যে লুকিয়ে আছে আত্মশুদ্ধি, মানবিকতা ও সহমর্মিতার বাণী।

স্থানীয় এক প্রবীণ বাসিন্দা বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমরা এই রথযাত্রা দেখে আসছি। প্রতিবার এটি যেন আমাদের সংস্কৃতিকে নতুন করে ছুঁয়ে যায়। এই উৎসবই আমাদের আত্মপরিচয়ের মূল ভিত্তি।”
এই বিশাল আয়োজনে স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবক দল, স্বাস্থ্যকর্মী ও সৈনিক ক্লাবের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। ভিড় নিয়ন্ত্রণ, যানবাহন ব্যবস্থাপনা, প্রাথমিক চিকিৎসা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল নজরকাড়া।

আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, উল্টো রথের দিনেও অনুরূপ আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। সকল ভক্ত ও দর্শনার্থীদের সেদিনও উপস্থিত থাকতে আহ্বান জানানো হয়েছে।পাথারকান্দির রথযাত্রা আজ শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় আচার নয়—এটি একটি সমাজ, একটি ঐতিহ্য এবং একটি চেতনার বহিঃপ্রকাশ। যুগের পর যুগ ধরে এই উৎসব যেমন ভক্তিকে ধারণ করেছে, তেমনি ঐক্য ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই রথযাত্রাই স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের শিকড়, আমাদের বিশ্বাস এবং আমাদের অস্তিত্ব।