সবাই যখন ঘুমে অচেতন…

।। সঞ্জীব দেবলস্কর।।
(লেখক, শিক্ষাবিদ)
২৩ সেপ্টেম্বর : প্রাক্তন জঙ্গিদের দাবি, কাছাড়ের লক্ষীপুর মহকুমার ১৯টি গ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে ডিমাহাসাও জেলার সঙ্গে যুক্ত করা হোক। এর ওপর আরেকটি বায়না—- সঙ্গে চন্দ্রনাথপুর থেকে জিরিঘাট বাজার পর্যন্ত অঞ্চলের ৯৬টি গ্রামও পার্বত্য জেলার সঙ্গে দিয়ে দিতে হবে। এ মর্মে এদের সঙ্গে সরকারের গোপন চুক্তির কথাও শোনানো হচ্ছে। এ কোন ভারতবর্ষের চেহারা! প্রস্তাবটি নিছক প্রশাসনিক পুনর্গঠনের প্রস্তাব নয়। এ যে  ঔপনিবেশিক আমলের ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতির আধুনিক সংস্করণ।

ঐতিহাসিক কাল থেকে কাছাড়ে ডিমাসা ও বাঙালি সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ছিল সুসমন্বিত ও সৌহার্দ্যপূর্ণ। বঙ্গভাষীদের সাহচর্যে কাছাড়ে  ডিমাসা অধ্যুষিত অঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের পথ প্রশস্ত হয়। মাইবং রাজসভা থেকে সমতলে ডিমাসা রাজত্ব সম্প্রসারিত করার প্রক্রিয়ায়ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। রাজসভার নথিপত্র, সনদ, প্রস্তরলিপি ও মুদ্রায় বাংলাভাষার ব্যবহার, এমনকি স্বয়ং  রাজাদের বাংলায় রচিত শাক্তগীতি, বৈষ্ণবীয় পদ, রাসোৎসব গীতামৃত প্রমাণ করে এই সহযোগিতা এবং সহাবস্থানের  ভিত্তি অতি দৃঢ়।

কিন্তু আজ সেই অঞ্চলের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিভেদের বীজ ছড়িয়ে দেওয়া নতুন অতঙ্কের সৃষ্টি করছে। বিশেষত সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি, এবং সঙ্গে মণিপুরি, রাজবংশী, খাসি, হিন্দিভাষীসহ অন্যান্যদের—প্রশাসনিকভাবে নিজ জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভিন্নতর ভূ-আইনের অধীন পার্বত্য জেলার সঙ্গে জুড়ে দেবার বিষয়টি  সরকারের বিবেচনাধীন। এর অর্থ—-বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে নিজ ভূমিতেই পরবাসী করে দেওয়া। একটি জনকল্যাণমুখী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটা নিছক এক প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, গভীর রাজনৈতিক চক্রান্তও বটে।

অঞ্চলটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট মনে করলেই স্পষ্ট হবে এ অযৌক্তিক প্রস্তাবের অন্তসারশূন্যতা।

১৮শ শতকের পূর্ব থেকেই লক্ষীপুর অঞ্চলে বাঙালির বসতি, কৃষিভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা ও অর্থনৈতিক জীবনকে সুসংহত রূপ দান করার অবদান ইতিহাস স্বীকৃত। ওই পর্ব থেকে বিশ শতকের দিকে এগিয়ে এলে দেখা যাবে এ ভূমির চেহারা পালটে গেছে। মানুষজনের মধ্যে জাতীয় চেতনার সঞ্চারও ঘটেছে।

১৯২১ সালে গঙ্গাদয়াল দীক্ষিতের নেতৃত্বে এ এলাকার মানুষ স্বদেশী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ইতিপূর্বে ১৯১৩ সালে বড়খলার রায়বাহাদুর বিপিনচন্দ্র দেবলস্কর, যিনি ছিলেন লক্ষীপুরের মৌজাদার এবং আসাম বিধান পরিষদের সদস্যও, তাঁরই  উদ্যোগে আসামের গভর্নর আর্চডেইল আর্ল লক্ষীপুরে এসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য একখণ্ড জমি ও অর্থদান করেন, আর্ল স্কুল নামে (বর্তমানে হায়ার সেকেন্ডারি) গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠান বহুভাষী অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার দায়িত্ব পালন  করছে সগৌরবে। রায়বাহাদুর বিপিনচন্দ্রের নামে লক্ষীপুরের একটি মধ্যবঙ্গ স্কুলও এর সাক্ষ্য বহন করছে।

১৯৬০-এর ভাষা আন্দোলনে ডিমাসা সহ নানা জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মধ্যেই লক্ষীপুরের ঐক্যবদ্ধ রূপের প্রকাশ দেখেছি আমরা।

কিন্তু এখন এই ঐতিহ্যের পরিপন্থী একতরফা সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস নেওয়া হচ্ছে। আশঙ্কা তো অমূলক নয়, এতে—
১. বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে কৃত্রিম বিভাজন তৈরি হবে।
২. বহু শতাব্দী ধরে বসবাসকারী বাঙালিসহ অন্যান্য সম্প্রদায় তাদের জমি ও সম্পত্তির অধিকার হারানোর আশঙ্কায় পড়বে।
৩. সামাজিক সৌহার্দ্যের ভাঙন ঘটবে, যার ফল হবে অশান্তি।

খবরে প্রকাশ কারা যেন ইতিমধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেছেন, যেখানে এই সিদ্ধান্তকে অসাংবিধানিক, বৈষম্যমূলক ও ইতিহাসবিরোধী বলা হয়েছে। সচেতন শান্তিকামী জনগণের পক্ষ থেকে দাবি উঠছে :
১) অবিলম্বে লক্ষীপুরের ১৯টি এবং সঙ্গে কাছাড়ের আরও ৯৬টি গ্রামকে বিচ্ছিন্ন করার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা।
২) বাঙালি জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া।
৩) নীতি প্রণয়নে স্থানীয় জনগণের মতামতকে অগ্রাধিকার দেওয়া।                

এ ভূমির জনপ্রতিনিধিদের কোনও প্রতিক্রিয়া এখনও শোনা যাচ্ছে না, কিন্তু মানুষের মনে ক্ষোভ ক্রমে জাগছে। এ অঞ্চলে আছেন এক সচেতন শিক্ষাবিদ যিনি পরম মমতায়  লিখে গেছেন ‘ইতিহাসের আলোকে লক্ষীপুর মহকুমা।’ এতে একটি বিশেষ বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা খুব প্রাসঙ্গিক। লেখক আবিদ রাজা মজুমদার বইতে ১৯২১-২২-এর অসহযোগ আন্দোলন, ১৯৩০-এর আইন অমান্য, ১৯৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলনে লক্ষীপুর অঞ্চল থেকে অংশগ্রহণকারী, প্রায় চল্লিশটি নামের একটি তালিকা দিয়েছেন। তালিকাটি দেখলেই বোঝা যায় এ ভূমির হয়ে ওঠাতে কা’দের ভূমিকা কতটুকু ছিল।  অঞ্চলটিতে পাঠশালা থেকে ডিগ্রি কলেজ পর্যন্ত ৬৬টি তিলে তিলে গড়ে ওঠা  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে নজর দিলে বোঝা যায় এসবের পিছনে কা’দের  স্বপ্ন, অর্থ, শ্রম ও ত্যাগ রয়েছে। এসব বিবেচনায় না এনে আজ প্রধান হয়ে গেল জেলা বহির্ভূত কতিপয় বন্দুকধারী প্রাক্তন জঙ্গির প্রস্তাব। যাদের প্রয়াসে লক্ষীপুর আজকের জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে এদের উত্তরপুরুষদের অধিকারের কথা কি কেউ  বলবে না ? শতাব্দীপ্রাচীন ‘খিলঞ্জিয়া’ বাঙালি, মণিপুরি, ডিমাসা এবং অন্যান্যদের সঙ্গে দেশভাগের বলি উদ্বাস্তুদেরও মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা এই শান্ত, সমৃদ্ধ অঞ্চলটিকে  একট  উদ্বাস্তু শিবির বানানোর কুটিল পরিকল্পনা কি কারও চোখে পড়বে না ?

আমাদের ব্রাত্যজনের এ ভাষাচার্য  এ অঞ্চলের কনকপুর গ্রামে বসে গভীর মমতা দিয়ে লিখেছেন  মাতৃভাষার অভিধান। তাঁর  প্রিয় সেই মাতৃভূমির পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলে তাঁর কষ্ট বোঝার কি কেউ থাকবে না ? এ প্রস্তাবিত সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে কেবল অঞ্চলটির মানচিত্রের পরিবর্তন নয়, এক ঐতিহাসিক অঞ্চলের জনগোষ্ঠী রূপান্তরিত হবে  প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে।

পরিণামে কাছাড় তথা বরাকের জন্য এটি হবে ১৯৪৭-এর দেশভাগের মতোই আরেকটি বেদনাদায়ক অধ্যায়ের সূচনা।

Spread the News
error: Content is protected !!