ডলুতে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হবে উপত্যকার আকাশ পরিবহনে নয়া যুগ
।। মনজুর আহমদ বড়ভূইয়া।।
(লেখক ও সাংবাদিক)
৯ ডিসেম্বর : মহাসড়কের পাশে শিলচর সদর সার্কলের রাজনগর পরগণার ডলু গ্রান্ট বা ডলু চা বাগানে একটি আন্তর্জাতিক গ্রিনফিল্ড এয়ারপোর্ট নির্মাণের জন্য প্রক্রিয়া চলছে। এই চা বাগান সরকার নিজের ইচ্ছায় পছন্দ করেনি। বরাক উপত্যকার কোথায় বিমানবন্দর নির্মাণ করা যায় তার প্রাক-সম্ভাব্যতা (প্রি-ফিজিবিলিটি) খতিয়ে দেখেছিল এয়ারপোর্ট অথরিটি অব ইন্ডিয়া (এএআই)। তারা শিলকুড়ি, খরিল এবং ডলু—এই তিনটি স্থানের মধ্যে শেষোক্তকে বাছাই করে। এই প্রক্রিয়ায় এগিয়ে গিয়ে কাছাড় জেলা প্রশাসন বাগান কর্তৃপক্ষ, সবকটি ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনা করে এবং লিখিত সম্মতি সাপেক্ষে ২৫০০ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করে। সেটা ২০২২ সালের এপ্রিল মাসের ঘটনা। বাগানের এই জমি সমঝে নিতে গিয়ে প্রশাসন তুমুল বাধার মুখে পড়ে। পরবর্তীতে ন্যাশনেল গ্রিন ট্রাইবুনাল (এনজিটি) এবং সুপ্রিম কোর্টে আপিল মামলা দায়ের হয়। চলতি বছরের ৬ মে সুপ্রিম কোর্টে আপিল মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। অর্থাৎ এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ আদালতে কোনো মামলা বিচারাধীন নয়।
গত ৫ মে, বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় অসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রী কিঞ্জারাপ্পু রামমোহন রেড্ডি লোকসভায় জানিয়েছেন যে দেশে নয়টি গ্রিনফিল্ড এয়ারপোর্টের জন্য কেন্দ্র সরকার ‘সাইট ক্লিয়ারেন্স’ দিয়েছে। এই নয়টির মধ্যে কাছাড়ের ডলুতে নির্মিতব্য গ্রিনফিল্ড এয়ারপোর্টও রয়েছে। যে বিমানবন্দর নির্মিত হবে সেটাতে ‘এ-৩২১’ বোয়িং বিমান সহজে ওঠানামা করবে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে বিমানবন্দর নির্মাণে সব বাধা দূর হচ্ছে এবং প্রক্রিয়াটি ধাপ পেরোচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন,ডলুতে বিমানবন্দর নির্মাণে যে শক্তিটি বাধা দিতে গোড়া থেকেই সক্রিয় ছিল, এখনও রয়েছে, তারা কী বরাক উপত্যকার আকাশ পরিবহনের সোনালি সম্ভাবনার পথে অন্তরায় হবে না? কারণ,আইনি প্যাঁচে ফেলে ডলুতে বিমানবন্দর নির্মাণ আটকে দিতে যারা এনজিটি-সুপ্রিম কোর্টে মামলা ঠুকেছিল,তারা কারা? এরা কেউই এই উপত্যকার কেউ নন। মামলাকারী হিসেবে কলকাতা যাদবপুরের তাপস গুহ,কাকুড়গাচির প্রদীপ রায় এবং নাকতলার বৈদ্যনাথ সেনগুপ্ত নামে তিন ব্যক্তির নাম রয়েছে। এরা ডলু কোথায়,কোন পথে যেতে হয়, কে শ্রমিক, কে শ্রমিক নয় তার কিছুই জানেনা। তারা কখনও বরাক উপত্যকায় এসেছে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। এরা এই উপত্যকার একটি ক্ষুদ্র প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মদতে মামলা করেছে। প্রশ্ন হতে পারে, এনজিটি বা সুপ্রিম কোর্টের ব্যয়বহুল মামলার অর্থের যোগান দিচ্ছে কে? ডলুতে যাতে বিমানবন্দর নির্মাণ না হয় সেজন্য প্রথমে এনজিটি, পরে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েও পথ রুদ্ধ করতে সচেষ্ট ছিল কলকাতার স্বার্থান্বেষী লবি। স্বভাবতই এদের ভূমিকা এখন আতসকাচের তলায়। যেখানে ডলুর সঙ্গে এই ত্রয়ীর কস্মিনকালেও কোনও সম্পর্ক নেই বা ছিল। তাহলে তারা কেন হঠাৎ শ্রমিক দরদী হয়ে গেলেন ?
লোকসভায় কেন্দ্রীয় অসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, দেশে বিমান এবং যাত্রী চলাচল সুগম করতে ৫০টি নয়া বিমানবন্দর নির্মাণের লক্ষ্য নিয়েছে কেন্দ্র। এর মধ্যে ২১টি গ্রিনফিল্ড এয়ারপোর্টকে ‘ইন-প্রিন্সিপল অ্যাপ্রুভেল’ প্রদান করা হয়েছিল। ১২ টি গ্রিনফিল্ড এয়ারপোর্ট ইতিমধ্যে চালু হয়ে গেছে। এর পাশাপাশি রাজস্থানের আলোয়ার ও কোটা, মধ্যপ্রদেশের সিংরৌলি,হিমাচল প্রদেশের মান্ডি, কেরালার কোট্টায়াম, ওড়িশার পুরি, অসমের ডলু, তামিলনাড়ুর পারান্ডুর এবং কর্ণাটকের রাইচুরে নয়টি গ্রিনফিল্ড এয়ারপোর্টের জন্য ‘সাইট ক্লিয়ারেন্স’ দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ করতে হচ্ছে যে গ্রিনফিল্ড এয়ারপোর্ট নির্মাণের জন্য প্রথমেই জমির প্রয়োজন। পরবর্তী ধাপ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের পক্ষে আবেদন। এই আবেদন করতে গিয়ে রাজ্য সরকার প্রথমাবস্থায় ৩২৫ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করেছে। এর মধ্যে কেন্দ্র সরকার প্রথমে ‘ইন-প্রিন্সিপল অ্যাপ্রুভেল’ এবং পরে ‘সাইট ক্লিয়ারেন্স’ দিয়েছে। যদিও ওই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী সর্বত্র মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয়। তারা আদালতে বলেছে যে ডলু চা বাগানের ১২০২ হেক্টর জমিতে ১ কোটি ২০ লক্ষ বাঁশ রয়েছে। বিমানবন্দর গড়ে তুললে তা কেটে ফেলা হবে। যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াবে। এনজিটি কলকাতার ওই তিন ব্যক্তির আবেদনকে নাকচ করে দেয়। এতেও ওরা ক্ষান্ত না হয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। যদিও সুপ্রিম কোর্ট কখনও বিমানবন্দর নির্মাণ করা যাবে না কথাটা বলেনি। আদালত পদ্ধতিগত ত্রুটি নিয়ে প্রশ্ন তুলে। সমান্তরালভাবে মামলাকারী তিন ব্যক্তির উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেন দেশের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা। শুনানি চলাকালেই তিনি বলেন যে ঘটনাস্থল থেকে মামলাকারীদের বাড়ির দূরত্ব ১৩০০ কিলোমিটার। আর তারা স্বঘোষিত এক্সপার্টও। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কাছাড়ের ডিস্ট্রিক্ট লিগ্যাল সার্ভিস অথরিটি একটি রিপোর্ট দেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন যে ওখানে ৪১,৯৫,৯০৯ টি চা গাছের চারা উপড়ে ফেলা হয়েছে। ওরা এনজিটিতে বলেছে যে চা গাছের চারা উপড়ে ফেলতে ১০৫০ টি জেসিবি ব্যবহৃত হয়েছে। রিপোর্ট বলছে,২০০-২৫০ টি ব্যবহার করা হয়েছে। ওদের ভাষ্য ছিল যে ১০ হাজার ‘শ্যাডো ট্রি’ মানে চায়ের চারাকে ছায়া দেয় এমন গাছ কাটা হয়েছে। রিপোর্ট মতে,৮৯ টি শিরিশ গাছ কাটা হয়েছে। অসমে পরিবেশ ছাড়পত্র প্রদান করে স্টেট এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট অথরিটি (সিয়া)। এই সংস্থাটি সরকারকে বলেছে যে চা বাগানে চারা গাছ উৎপাটন ও রোপণ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এতে পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
তাই সবপক্ষের শুনানি গ্রহণ করে সুপ্রিম কোর্টের মুখ্য বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ আপিল মামলার নিষ্পত্তি করেন। এতে বলা হয়েছে, ‘In consequence,there shall be a direction that absolutely no activity shall be carried out in breach of the provisions of the notification dated 14th September 2006 at the site of the proposed greenfield airport at Silchar’। অর্থাৎ ইআইএ নোটিফিকেশনের বিধি ভেঙে ওখানে কিছু করা যাবে না। আদালত তো বলেনি যে বিমানবন্দর নির্মাণ করা যাবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, বরাক উপত্যকার অগণিত সমস্যা যেমন বর্ষায় শিলচর-গুয়াহাটি সড়কে ভূমিস্খলন এবং সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে থাকা, অসম্পূর্ণ মহাসড়ক, রেললাইনজনিত দুর্ভোগ, শিলচর শহরের যানজট ইত্যাদি নিয়ে কলকাতার ওই তিন ব্যক্তি কেন মামলা করতে গেলেন না? ডলু চা বাগানের বাঁশ ও গাছ নিয়ে তাদের দরদ উতলে পড়ার কারণ কী? ৮৯টি শিরিশ গাছ এবং ১৬৯টি শ্রমিক-ঘরের র জন্য কী বিমানবন্দর নির্মাণ হবে না ? কিন্তু পাশাপাশি এটাও যথেষ্ট বিস্ময়ের যে এই ক্ষুদ্র প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে প্রতিরোধ করতে বরাক উপত্যকার রাজনীতিক নেতৃবৃন্দ, নাগরিক সমাজ নীরব। অথচ বিমানবন্দর নির্মিত হলে তারাই অধিক ব্যবহার করবেন।