ডিপ্রেশন প্রতিকার ও উপায়
।। ববিতা বরা ।।
১৪ মে : যুব প্রজন্মের মাঝে দেখা পাওয়া একটি সবচেয়ে ভয়াবহ সমস্যা হল ডিপ্রেশন। অনেকে হয়তো এই সমস্যায় ভুগেছে, কিছু সংখ্যক হয়তো এর সঙ্গে লড়াই করে জয়ীও হয়েছে এবং অনেকে হয়তো এখনও এর সঙ্গে লড়াই করছে।
ডিপ্রেশন কী?
এই সমস্যাটি মূলত মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত। একে রোগ বলা যায় না, এটি একটি অস্থির মানসিক অবস্থা, অথচ এটি হাজারও শারীরিক-মানসিক রোগের জন্ম দিতে পারে।
প্রকারভেদ:
মূলত দুই ধরনের—
১. মেজর ডিপ্রেশন– এই ধরনের ডিপ্রেশন নতুন প্রজন্মের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায়। এটি ২ সপ্তাহ থেকে এক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
২. পারসিস্টেন্ট ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার– এটি মেজর ডিপ্রেশনের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। যথাযথ চিকিৎসা না হলে এটি ২ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। (Source: from internet)
ডিপ্রেশনের কারণসমূহ
ব্যক্তি ভেদে ও বয়স ভেদে ডিপ্রেশনের কারণগুলো ভিন্ন হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে একধরনের মিল দেখা যায়। সাধারণত এর কারণগুলো হলো—
১. জেনেটিক কারণ
২. পারিপার্শ্বিক কারণ
৩. সামাজিক কারণ
৪. সাইকোলজিক্যাল কারণ
যুব সমাজে দেখা যাওয়া কিছু প্রধান কারণ:
১. Anxiety, অর্থাৎ ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ– অতিরিক্ত ভবিষ্যতের চিন্তা আমাদের মনে চাপ বাড়ায়, যার ফলে মস্তিষ্কে চাপের পরিমাণ বেড়ে যায়।
২. আত্মীয়-বন্ধুদের আঘাত – অনেক সময় ভুল বন্ধু বা আত্মীয়ের কাছ থেকে পাওয়া আঘাত হৃদয়ে ও পরে মস্তিষ্কে গভীর প্রভাব ফেলে।
৩. পড়াশোনা বা অন্য চাপ – অতিরিক্ত চাপ মন এবং মস্তিষ্ককে বিভ্রান্ত করে তোলে ও ডিপ্রেশনের জন্ম দেয়।
৪. পারিবারিক সমস্যা– অর্থনৈতিক সমস্যা, প্রিয়জনের অসুস্থতা বা দুঃখ আমাদের মনকে দুর্বল করে দেয়। ছোট ছোট চিন্তাগুলো ধীরে ধীরে বড় হয়ে গিয়ে দুঃখজনক কল্পনায় রূপ নেয়, যা ডিপ্রেশনের কারণ হয়।
৫. ভিন্ন পরিবেশে মানিয়ে চলার অসুবিধা– আমার মতো অন্তর্মুখী মানুষের এটি একটি বড় সমস্যা। সঠিক মানিয়ে চলতে না পারলে সমস্যা সৃষ্টি হয়, যা পরে ডিপ্রেশনের রূপ নেয়।
৬. একাকীত্ব– মনের কথা বলার সুযোগ না থাকলে মানুষ খুশি থাকতে পারে না। সীমাবদ্ধ পরিবেশে বড় হওয়া অন্তর্মুখী মানুষের কাছে একাকীত্ব এক পরিচিত অনুভূতি।
৭. অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা ও বিচারধর্মী মনোভাব– অন্যায়ের প্রতিবাদী, মিথ্যা সহ্য করতে না পারা, অরাজকতা অসহ্য হওয়া– এই বৈশিষ্ট্যগুলো সহজেই মনকে বিরক্ত করে তোলে, এবং পরে এক ধরণের ‘irritation’-এর জন্ম দেয় যা ডিপ্রেশনে পরিণত হতে পারে।
প্রভাবগুলো হল, এই সমস্যা আমাদের শরীর ও মন দুটোর ওপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
১. আগ্রহ হারানো– প্রতিদিনের কাজে বিরক্তি আসে।
২. মুড সুইং বা দুঃখ– মন ভারী হয়ে থাকে।
৩. কোনও কিছুর প্রতি আগ্রহ না থাকা– নিজের পছন্দের জিনিসেও আর মন বসে না।
৪. অস্থিরতা– ঘুমে সমস্যা হয়। কেউ নিদ্রাহীনতায় ভোগে আবার কেউ অতিরিক্ত ঘুমায়।
৫. মনোযোগের অভাব– কাজের প্রতি দায়িত্ববোধ হারিয়ে যায়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়।
৬. হতাশা– মন থেকে ইতিবাচক শক্তি হারিয়ে যায়।
৭. আত্মহত্যার চিন্তা– মন দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেক সময় এমনও হয় যে মন ভয়, দুশ্চিন্তায় এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যে আত্মহত্যার চিন্তাও আসে।
প্রতিকার ও উপায়:
ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির সবচেয়ে ভালো ওষুধ হল নিজের মানসিক মনোবল বাড়ানো ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবন উপভোগ করা।তবুও কখনও কখনও অন্যের সহায়তা নেওয়া খুবই দরকার হয়।সব মানুষের কাছ থেকে সহায়তা আশা করা ঠিক না। তাহলে কার থেকে সহায়তা চাইব? আমার মতে, যাদের থেকে সহায়তা নেওয়া যায় তারা হলো:
– নিজের অভিভাবক
– সবচেয়ে প্রিয় বা বিশ্বাসযোগ্য বন্ধু
– চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায় এমন আপনজন
মন খোলার মাধ্যমে মানসিক চাপ অনেকটাই কমে যায়।

যদি এদের কারোর সান্নিধ্য না থাকে তবে?
তাহলে কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে—
১. জোর করেও নিজেকে ভালো রাখতে হবে।
২. নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে হবে, নিজেকে বোঝাতে হবে।
৩. মন খুলে কাকেও বলতে না পারলে লিখে ফেলতে হবে।
৪. যেসব কারণে মন খারাপ হয়, সেগুলো চিহ্নিত করে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে হবে।
৫. সব নেতিবাচক চিন্তার সঙ্গে জড়িত বস্তু, ব্যক্তি, স্মৃতি জীবন থেকে বাদ দিতে হবে।
৬. দুঃখদায়ক সিনেমা, লেখা, ছবি, ব্যক্তি, ঘটনা থেকে দূরে থাকতে হবে।
৭. নিজেকে সময় দিতে হবে, মনকে শান্ত রাখতে হবে। প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকার চেষ্টা করতে হবে।
৮. উদ্দীপনামূলক বক্তব্য শোনার অভ্যাস গড়তে হবে।
একটি কথা মনে রাখতে হবে—
অন্যের সহায়তায় আপনি শুধু সাময়িকভাবে মনকে হালকা করতে পারবেন। প্রকৃত চিকিৎসক আপনি নিজেই। আপনি নিজেই পারেন নিজের মনকে শক্তিশালী করে ডিপ্রেশন থেকে উদ্ধার করতে।
অভিভাবকদেরও দায়িত্ব আছে—
– সন্তানের সঙ্গে সময় কাটান
– তাদের মনোভাব শুনুন
– বন্ধুর মতো আচরণ করুন
– এমন পরিবেশ দিন যাতে তারা মুক্ত মনে কথা বলতে পারে
– প্রয়োজনমতো শিথিল হোন
– অতিরিক্ত শাসন করবেন না
এই লেখাটি পুরোপুরি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। আমি যেসব নিয়ম মেনে চলেছি, সেগুলোই এখানে উল্লেখ করেছি। মনোবল দিয়েই আমি একমাসের মধ্যে নিজেকে এই সমস্যা থেকে মুক্ত করতে পেরেছি। ডিপ্রেশনের কারণে আমি কিছু অন্যান্য শারীরিক সমস্যাতেও ভুগেছিলাম। তবে অভিভাবক ও বন্ধুদের বোঝানো এবং নিজের মনোবলের মাধ্যমে আমি আবারও জীবনের ইতিবাচক রঙগুলো অনুভব করতে পেরেছি। চিকিৎসা, ওষুধ বা অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আমি অভিজ্ঞ না হওয়ায় সেগুলো বিস্তারিতভাবে লিখতে পারিনি।