দিশারীর ৪৫তম প্রতিষ্ঠা দিবসে রাজ্যে ঐক্যবোধ ছিন্ন করার প্রবণতায় উদ্বেগ

বরাক তরঙ্গ, ২১ জুলাই : রাজ্যের এক সংকটময় মুহূর্তে ভেদবাদী প্রবাহের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে লড়াই করার জন্য শিলচরে গড়ে তোলা হয়েছিল ‘দিশারী’ সংগঠন। রাজ্যে ভাষা ও ধর্মের ঐক্যবোধ ছিন্ন করার প্রবণতায় গভীর উদ্বেগ ব্যক্ত করে সাড়ে চার দশকের এই লড়াইকে চালিয়ে নিয়ে যেতে আবারও অঙ্গীকারের কথা উচ্চারিত হলো শনিবার শিলচরে সংগঠনের ৪৫ তম প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপন কার্যক্রমে। প্রবীণ সমাজকর্মী ও সাংস্কৃতিক সংগঠক দিশারীর সভানেত্রী গৌরী দত্ত বিশ্বাসের পৌরোহিত্যে আয়োজিত কথা, গানের অনুষ্ঠানমালায় উঠে এলো বরাক উপত্যকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের গৌরব গাথা, দিশারীর লড়াইয়ের কথা।

সংগঠনের সদস্য প্রয়াত কথাশিল্পী দেবব্রত চৌধুরী লেখা ‘স্বদেশ মোদের মঞ্চ’ সমবেত সঙ্গীত দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। প্রারম্ভিক বক্তব্যে সবাইকে স্বাগত জানান দিশারীর সংস্কৃতি সম্পাদক সঞ্জয় দেব লস্কর। কথা পর্যায়ে শুরু হয় স্মৃতিচারণ, সংগঠনের ঐতিহ্যের পর্যবেক্ষণ। এই পর্বে আলোচনার সূত্রপাত করে সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী বলেন, অনেক চড়াই উতরাই অতিক্রম করে দিশারী তার কার্যধারা আজও অব্যাহত রেখেছে। নিছক সংস্কৃতি চর্চা নয়, জীবনবোধের আধারে প্রতিটি সাংস্কৃতিক কার্যক্রম রূপায়ন করার ধারা বিগত চৌচাল্লিশ বছরে ধরে অব্যাহত রয়েছে। আগামীতেও এই ধারা অব্যাহত রাখার প্রয়াস চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা থাকবে। গৌরী দত্ত বিশ্বাস এ রাজ্যের জাতি ও ধর্মকেন্দ্রিক বিদ্বেষ চিত্র উল্লেখ করে দিশারী গঠনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন স্মরণ করেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী অনুরূপা বিশ্বাস, অন্যতম পুরোধা অনন্ত দেব, শক্তিপদ ব্রহ্মচারী, বিজিত চৌধুরী, মৃণাল কান্তি দত্তবিশ্বাস প্রমূখ ব্যক্তিত্বের নিরলস প্রয়াসের কথা। বলেন, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একদল দামাল ছেলে-মেয়ের সংগঠিত কর্মকাণ্ডে দিশারীর ঐতিহ্যের যে ধারা শুরু হয়েছিল আজও তা আপন স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল।

সংগঠনের প্রথম সাধারণ সম্পাদক গৌতম প্রসাদ দত্ত গেল শতাব্দীর আটের দশকের সূচনায় রাজ্যে ভাষাবিদ্বেষ থেকে জাতিবিদ্বেষে রূপান্তরিত বিদেশী খেদা আন্দোলনের ভয়ংকর আবহের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, গণনাট্য সংঘের ভাবধারায় সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে লড়াইর অঙ্গীকার নিয়ে ১৯৮০ সালের ২০ জুলাই শিলচরে দিশারী গঠন করা হয়। সংগঠনের রূপরেখা তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রয়াত গণশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস থেকে শুরু করে হোমেন বরগোহাঞি, সৈয়দ আব্দুল মালিক, অমলেন্দু গুহ, নিরুপমা বরগোহাঞি, প্রতিমা পাণ্ডে, নবকান্ত বরুয়া প্রমূখ উদারবাদী ব্যক্তিত্বরা দিশারির মঞ্চে ছুটে এসেছিলেন। দিশারী আয়োজিত মৈত্রী উৎসব এ রাজ্যের বিভিন্ন ভাষা ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ভাব বিনিময়ের মঞ্চ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সেদিনও এই প্রয়াসে মেলেনি কোনও সরকারি আনুকূল্য। সেই ধারা আজও অব্যাহত। তবে এজন্য দিশারির কাজকর্মে ছেদ পড়েনি। নানামাত্রায় তার কর্মধারা অব্যাহত রয়েছে। দিশারির মৈত্রী উৎসব কার্যক্রমের প্রথম সম্পাদক সব্যসাচী পুরকায়স্থ সংগঠনের গৌরবময় দিনগুলির কথা উল্লেখ করে বলেন, প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে একই জীবনবোধ নিয়ে চলা এই সাংস্কৃতিক সংগঠন এক অধ্যায় তৈরি করেছে।

স্মৃতিচারণ পর্বে আলোচনায় অংশ নিয়ে সংগঠনের সূচনা পর্ব থেকে অগ্রণী বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য, প্রবীর কুমার দাস, সঞ্জীব দেব লস্কর, শিপ্রা পুরকায়স্থ, তন্ময় মজুমদার, আলোকরঞ্জন ভট্টাচার্য, পিনাক চক্রবর্তী প্রমূখ দিশারীর বিভিন্ন কর্মকান্ডের চিত্র তুলে ধরে বলেন, উপত্যকার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একদিন নিশ্চয়ই এই সংগঠনের কর্মকাণ্ডের যথার্থ মূল্যায়ন হবে। একুশে জুলাই ভাষা শহিদ দিবসের প্রাক্কালে অনুষ্ঠিত এই স্মৃতিচারণ সন্ধ্যায় সঙ্গীতে শহিদ তর্পণ করেন তাপসী দত্ত। এছাড়া সঙ্গীতে অংশ নেন দিবায়ন দাস ও গীতাঞ্জলি দত্ত। গোটা অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সঞ্জয় দেব লস্কর। 

Author

Spread the News