অমর ১৯শের চেতনা ও কিছু প্রস্তাবনা
।। মওলানা মহবুবুর রহমান।।
বরাক তরঙ্গ, ১৮ মে : রক্তে রাঙা ১৯ শে মে’ আগামীকাল! যে দিন আমরা হারিয়েছিলাম ১১ টি তাজা প্রাণ। উগ্র জাতীয়তামূলক আগ্রাসনের প্রতিবাদে আত্মবলিদান দিয়েছিলেন আমাদের ঐ অমর শহিদরা। তাঁদের প্রতি রইলো শতকোটি শ্রদ্ধা।
সরকারের দমনমূলক নীতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠে আন্দোলন সাব্যস্ত করেছিলেন লক্ষ লক্ষ বাঙালি । ১৯৬১ সালের ১৯ মে’ ১১ জন, দশ ভাই চম্পা আর এক প্রতিবাদি পারুল বোনকে অসম প্রাদেশিক পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। যে ভাষা শহীদেরা আজো বাঙালির প্রাণ কাঁদায়, তাঁদের মধ্যে – শহিদ কমলা ভট্টাচার্য, শহিদ শচীন্দ্র পাল, শহিদ বীরেন্দ্র সূত্রধর, শহিদ কানাইলাল নিয়োগী, শহিদ চণ্ডীচরণ সূত্রধর, শহিদ সত্যেন্দ্র দেব, শহিদ হীতেশ বিশ্বাস, শহিদ কুমুদরঞ্জন দাস, শহিদ তারিণী দেবনাথ, শহিদ সুনীল সরকার ও শহিদ সুকুমার পুরকায়স্থ।
২০ মে’ শিলচরের জনগণ শহিদদের শবদেহ নিয়ে শোকমিছিল করে প্রতিবাদ সাব্যস্ত করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাধ্য হয়ে বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এপার–ওপার বাংলায় অবস্থান থাকলেও বাংলাই আমাদের মুখের ভাষা।
কবির কলমে, “আমরা বাংলায় হাসি, বাংলায় গাই, বাংলায় বুনি স্বপন, বাংলা মোদের মায়ের ভাষা, বাংলার তরে বিলাই জীবন।”
বাংলা আমাদের আবেগ প্রকাশের মাধ্যম। এই ভাষা রক্ষার্থে বাঙালিদের তাজা শরীর থেকে ঝরেছে রক্ত। ৫২’তে ঝরেছে ঢাকার রাজপথে। অন্যদিকে ১৯৬১ সালে মাতৃদেশ ভারতের অসমের শিলচরে, বরাক উপত্যকায়।
‘জান দেবো তবু জবান দেব না’ বাংলাভাষার দাবিতে আমাদের অগ্রজদের শ্লোগান ছিল এটি। একাগ্রতা বলেই বাঙালি সহস্র ঝড়– তুফান বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক শাস্তির সম্মুখীন হয়েও বেঁচে আছে মহীরুহের মত শিরদাঁড়া সোজা করে।
প্রখ্যাত কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী সৃষ্ট ‘উনিশে মে ১৯৬১ শিলচর’ কবিতায় ফুটে উঠেছে এক প্রতিবাদী আগুন ! ‘দশটি ভাই চম্পা আর একটি পারুল বোন কলজে ছিঁড়ে লিখেছিল এই যে ঈশান কোণ কোন ভাষাতে হাসে কাঁদে কান পেতে তা শোন । শুনলি না ?
তো এবার এসে কু–চক্রীদের ছা তিরিশ লাখের কণ্ঠভেদী আওয়াজ শুনে যা – বাংলা আমার মাতৃভাষা ঈশান বাংলা মা’।
আমরা বাঙালিরা যেন এই অমর শহিদদের তথা সমূহ প্রতিবাদীদের ভুলে না যাই। আমরা যেন আমাদের অতীতে ফিরে তাকাই।তা থেকে শিক্ষা নিয়ে মনোবল বাড়াই।চরম উদ্যমে স্বাভিমান, স্বাধিকার আদায়ে গণতান্ত্রিক লড়াই করে জেতার রসদ সংগ্রহ করি।আমরা দুর্বল নই।আমরা বাঙালি। অদম্য হোক মোদের প্রত্যয়। আমাদের রয়েছে অমর ইতিহাস।
শুধু আগামীকাল নয়, আমরা সদা যেন শহিদদের স্মরণ করি,, গান শুনি এবং বাংলা ভাষাকে সম্মান করে শুদ্ধভাবে বলার চেষ্টা করি।
এই পূণ্যলগ্নে সরকার সমীপে কিছু খোলা দাবি ও প্রস্তাবনা :
১) এনআরসি তালিকা থেকে বাদপড়াদের নাম শীঘ্রই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
২) এনআরসি প্রক্রিয়ায় বায়োমেট্রিক লক করার কারণে যাদের আধার কার্ড হচ্ছে না,তাদের বায়োমেট্রিক লক খোলে আধার কার্ডের ব্যবস্থা শীঘ্রই করতে হবে।
৩) আর কোনো প্রতিশ্রুতি নয়,শীঘ্রই ‘ডি ভোটার’ ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে।
৪) ডিটেনশন ক্যাম্প গুড়িয়ে দিতে হবে।
৫) আসন পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে বরাক উপত্যকার কেটে ফেলা দুটি বিধানসভা আসনকে পুনর্বহাল রাখতে হবে এবং ভোটার সংখ্যার নিরিখে আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।
৬) ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির সরকারি পদে স্থানীয় যুবক-যুবতীদের প্রাধান্য দিতে হবে।
৭) ভাষা আইন যথাযথ কার্যকর করতে হবে।
৮) মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে। মাতৃভাষার বিকাশে সরকারকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। বরাকের অফিস আদালতে অসমিয়া ভাষার মিলাপ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে।
৯) উপত্যকার বিভিন্ন স্কুলে ভাষা শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে।অনতিবিলম্বে তা পূরণ করে শিক্ষার্থীদের বঞ্চনার ইতি টানতে হবে।
১০) শিলচর রেলস্টেশনকে ‘ভাষা শহিদ স্টেশন’ নামকরণ তথা সরকারী স্বীকৃতিকরণ অতিসত্বর করতে হবে।
১১) ভাষা শহিদদের সরকারি মর্যাদা দিতে হবে। মেহরোত্রা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনতে হবে। শহিদ পরিবারগুলিকে সরকারি সাহায্য প্রদান করতে হবে।
১২) উনিশে মে বরাক উপত্যকায় স্থানীয় ছুটি বহাল রাখতে হবে।
১৩) সরকারি চাকরি যেমন টেট, স্লেট, নেট, ইত্যাদি কিংবা অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা কেন্দ্র (সিইউইটি ইত্যাদি) বরাক উপত্যকার তিন জেলায় স্থাপন করতে হবে।
১৪) বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটার দেওয়ার জন-অহিতকর সিদ্ধান্ত অচিরেই বাতিল করতে হবে।
১৫) বরাকের করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে দুটি মেডিকেল কলেজের দ্রুত সফল সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।
১৬) করিমগঞ্জ -হাইলাকান্দির উভয় জেলার শিক্ষার্থীদের সমস্যা নিরসনে সুপ্রাকান্দির হাওরে ও বক্রিহাওরে উন্নতমানের বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা সময়ের দাবি।
বরাকবাসীর একমাত্র কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় “আসাম বিশ্ববিদ্যালয়”- র শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে তথা সার্বিক উত্তরণে শিলচর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত একটি রেলরুট ও কম করেও একটি প্রাত্যহিক ট্রেন দেওয়া সময়ের দাবি। প্রত্যহ সকাল বিকাল একবার রটেশন হলেও অনেক সুবিধা হবে।
১৭) বরাকের পর্যটন কেন্দ্র সমূহের সংস্কার ও উত্তরণ সহ আরোও উন্নত মানের পর্যটনকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।
১৮) বেকার সমস্যার নিরসনে ও উপত্যকা তথা রাজ্যের অর্থনৈতিক উত্তরণে বরাকের বন্ধ কল কারখানা (পাঁচগ্রাম কাগজকল ও আনিপুর চিনিকল) পূণর্চালনসহ আরো দু চারটি কল কারখানা স্থাপন করা সময়ের দাবি।
১৯) করিমগঞ্জ-শিলচর হাইওয়ের প্রাত্যহিক যানজটের নিরসনে বদরপুরঘাট, কাটাখাল সহ প্রয়োজনীয় সমূহ ফ্লাইওভার অতিসত্বর বাস্তবায়ন করে বরাকবাসীর সুস্থ সুন্দর জীবনযাবনের ব্যবস্থা করতে হবে ।
২০) বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উত্তরণে বরাকের অগ্রণী সংগঠন “বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন” সহ অন্যান্য সমমনা সংগঠন কে আর্থিক সাবলীকরণ আবশ্যক।
আশা করি উন্নতমনস্কা উন্নয়নমুখী উদ্যমী সমন্বয়বাদী সরকারের আমলে বরাকবাসীর এ সমূহ দাবি অচিরেই পূর্ণ হবে।মহান উনিশে মে অমর রহে।